জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সম্পদের তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। শিগগিরই এ সংক্রান্ত মামলা করা হবে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধানের কার্যক্রম এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান দলটি প্রতিবেদন লেখার কাজও শেষ করেছে। প্রতিবেদনটি কমিশনের ঊর্ধ্বতনরা যাচাই বাছাই করছেন। সূত্র: মানবজমিন
সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বরে দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল অনুসন্ধান শুরু করে। পরবর্তীতে তার বদলিজনিত কারণে উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে ওই দলটি শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের অনিয়ম- দুর্নীতির খোঁজ নেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ইতিমধ্যে দলটি একাধিক মামলাও করেছে। যার মধ্যে প্লট জালিয়াতির অভিযোগে ছয়টি মামলার চার্জশিটও দিয়েছে দুদক।
দুদক সূত্র বলছে, জয়ের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে দেশে তার তেমন কোনো অবৈধ সম্পদ পাওয়া যায়নি। তবে সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে শেখ হাসিনাপুত্রের ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদের হদিস পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় ৫৩ কোটি টাকা মূল্যের দু’টি বাড়িরও সন্ধান পেয়েছে সংস্থাটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাপুত্রের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার কিছু বেশি। এটা স্থাবর অস্থাবর মিলিয়ে। আসলে তিনি তো যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে উঠেছেন। এখানে তার সম্পদ তেমন না থাকারই কথা। মামলায় অভিযোগ আনার মতো দেশে পাওয়া ১ কোটি ৪০ লাখ আর যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার দু’টি বাড়ির তথ্য রয়েছে।
অপর কর্মকর্তা বলেছেন, জয়ের বিরুদ্ধে দেশে অবৈধ সম্পদ না পাওয়ারই কথা। তবে দুদকের মূল ফোকাস ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের যে অভিযোগটি রয়েছে সেটি। ওই অনুসন্ধানটি চলমান। সেটি শেষ হলে অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা সম্ভব হবে।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, জয় যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি দু’টি কেনেন ২০১৪ সালের ৫ই মে এবং ২০২৪ সালের ৬ই জুলাই। এর মধ্যে ২০২৪ সালে কেনা বাড়িটি ওয়াশিংটনের গ্রেট ফলস এলাকার পার্কার হাউস ড্রাইভে অবস্থিত। একক মালিকানায় এই বাড়ির মূল্য ৩৮ লাখ ৭৯ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে কেনা বাড়িটি সজীব ওয়াজেদ ও তার সাবেক স্ত্রী ক্রিস্টিনা ওয়াজেদের যৌথ মালিকানায় কেনা হয়েছিল, যার দাম ছিল প্রায় ১০ লাখ ডলার। সেই সময়কার বিনিময় হার অনুযায়ী, বাড়িটির মূল্য ছিল ৭ কোটি টাকারও বেশি।
সূত্র জানায়, বাড়ি দুটি শনাক্ত করার পর সুনির্দিষ্ট দলিল-দস্তাবেজসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। কমিশন আদালতে জব্দের জন্য আবেদন করবে। আদালত থেকে আদেশ পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আইনি সহায়তার মাধ্যমে যোগাযোগ করে সম্পদগুলো জব্দের উদ্যোগ নেয়া হবে।
দেশের সম্পদ জব্দের আদেশ: গত ১১ই মার্চ সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানা সিদ্দিক এবং রেহানার সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিকের নামে থাকা জমিসহ বাড়ি ও ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এসব সম্পদের বাজারমূল্য ৮ কোটি ৮৫ লাখ ২৫ হাজার ৩২০ টাকা। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন গালিব দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। যেসব সম্পদ জব্দ করার আদেশ দেয়া হয়েছে- টিউলিপ সিদ্দিকের নামে গুলশানের ফ্ল্যাট।
এর বাজারমূল্য ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৯২০ টাকা। জয় ও পুতুলের নামে ধানমণ্ডিতে থাকা ১৬ কাঠা জমিসহ বাড়ি ‘সুধাসদন’। এর বাজারমূল্য ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। শেখ রেহানার নামে গাজীপুরে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা দামের সাড়ে ৮ কাঠা জমি, গাজীপুরে আরেক জায়গায় ৩ লাখ টাকা দামের ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ জমি এবং সেগুনবাগিচায় ১৮ লাখ টাকার ফ্ল্যাট। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির নামে গুলশানে থাকা ছয়টি ফ্ল্যাট জব্দ করা হয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য ৪ কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ: শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ৩০০ মিলিয়ন (৩০ কোটি) ডলার পাচারের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের মাধ্যমে এই তথ্য জানতে পেরেছে দুদক। গত ২২শে ডিসেম্বর এ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। অভিযোগটি দুদকের বিশেষ তদন্ত শাখাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর আগে ১৭ই ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, বোন রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ মেগা ৯ প্রকল্পের ৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
দুদক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সমপ্রতি শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিষয়ে একটি অভিযোগ প্রাথমিকভাবে তদন্ত করেছে। তদন্তে জয়ের গুরুতর আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি উঠে আসে। তার নামে থাকা হংকং এবং কেম্যান আইল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে স্থানীয় একটি মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ওয়াশিংটন ডিসি, নিউ ইয়র্ক এবং লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়।
এফবিআই তাদের লন্ডন প্রতিনিধির মাধ্যমে আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গুরুতর মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের সিনিয়র ট্রায়াল অ্যাটর্নি লিন্ডা স্যামুয়েলস স্পেশাল এজেন্ট লা প্রিভোটের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। ওই অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়।