শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১২:১৪ রাত
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ইলিশ এখন স্বর্ণের মতো: সাগরে কমছে উৎপাদন, চড়া দামে বাজার

ইলিশ ধরার ভরা মৌসুম চলছে। কিন্তু কক্সবাজার শহরের ৬ নম্বর ঘাটে মুখ ভার করে বসে আছেন জেলে নুর হাসান (৩৭)। গেল তিন মাসে ১০ বার সাগরে গেলেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাননি তিনি। প্রতিবারই ফিরে এসেছেন মাত্র একশ বা দুইশ ইলিশ নিয়ে। অথচ একবার সাগরে যেতে খরচ হয় প্রায় ৪ লাখ টাকা। কিন্তু সেই খরচের টাকাও উঠছে না বলে জানান জেলে নুর হাসান।

তিনি বলেন, ‘গত ৪-৫ বছর আগেও আমরা যখন সাগরে ইলিশ শিকারে যেতাম, তখন ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ইলিশে ট্রলার ভর্তি হয়ে যেত। ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে প্রায় ৩ থেকে ৬ হাজার ইলিশ নিয়ে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে চলে আসতাম। এটাকে ইলিশের বাম্পার উৎপাদন বলতাম। কিন্তু গত ২-৩ বছর ধরে দেখছি সাগরে ইলিশের উৎপাদন কমছে। এখন ১৪-১৫দিন সাগরে জাল ফেলেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মিলছে না। সরকারি এত নিষেধাজ্ঞার পরও কেন ইলিশ মিলছে না, এটা খুবই চিন্তার বিষয়।’

 
আগে ভরা মৌসুমে কক্সবাজারের ৬ নম্বর ঘাট থেকে বঙ্গোপসাগরের কিছুটা দূরে গেলেই পাওয়া যেত বড় ইলিশ। কিন্তু এখন ইলিশের খোঁজে অনেক গভীরে যেতে হয়, তাতে জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ বাড়ে। কিন্তু গভীর সাগরে গিয়েও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ।
 
আবু তৈয়ব মাঝি বলেন, ‘এবারের মতো এমন কম মাছ আগে দেখিনি। গত ৩ বছর ধরে মাছের গতি ভালো না। বড় মাছ পেতে অনেক দূরে সাগরে যায়। কিন্তু বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।’
 
 ৫-৬ বছর আগের কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘তখন ট্রলার ভর্তি ইলিশ আনতাম। সেই ইলিশ সেই সময়েই ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হতো। তখন ট্রলার মালিকও খুশি থাকত, আমরাও থাকতাম।’
 
তৈয়ব মাঝির মতো আরও অনেক জেলের কাছে সবকিছু যেন অচেনা হয়ে গেছে। কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর উপকূলে একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাগরে ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

ফিশারি ঘাট এলাকার ট্রলার এফবি গোলাবের জেলে মো. শফি (৪০) বলেন, ‘আগে সাগরে গেলে ৬-৭ দিনের মধ্যে যে ইলিশ পেতাম তাতে ট্রলারের বাজার খরচ উঠার পর অনেক টাকা ট্রলার মালিকের লাভ হতো। কিন্তু বর্তমানে ১৪-১৫ দিনেও সাগরে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মিলছে না। এতে লোকসানের পর লোকসান গুনতে হচ্ছে ট্রলার মালিকদের। যার কারণে ট্রলার মালিক আর সাগরে পাঠাচ্ছে না। এতে আমাদের সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
 

ধ্বংসের কারণ কি অবৈধ ট্রলিং?

অনেক জেলে, ট্রলার মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা সাগরে অবৈধ ট্রলিংয়ের দৌরাত্ম্যকে ইলিশ সংকটের মূল কারণ হিসেবে দায়ী করছেন।
 
কক্সবাজার শহরের ৬ নম্বর ঘাট সরেজমিন ঘুরে ও ট্রলার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাখ লাখ টাকা খরচ করে তৈরি করা হয় একেকটি ট্রলার। সেগুলো সাগরে গিয়ে ইলিশ ধরলেই চলে জেলে ও মালিকদের জীবন। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানের কারণে অনেকেই এখন ট্রলার সাগরে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের দাবি, সাগরে বেড়েছে শত শত অবৈধ ট্রলিংয়ের দৌরাত্ম্য। যার কারণে সাগরে কমে যাচ্ছে ইলিশের উৎপাদন।
 
শহরের মাঝির ঘাট এলাকার ট্রলার এফবি আবসারের মাঝি আব্দুল কাইয়ুম (৫২) বলেন, ‘সাগরে ইলিশ শিকারে গিয়ে ১৪-১৫ দিন জাল ফেলেও মাছ পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, সাগরে ইলিশ নেই। এটার জন্য অবৈধ ট্রলিং বোটগুলোই দায়ী। কারণ তারা যেভাবে মাছ শিকার করছে এতে মাছের পোনা থেকে ধরে সবকিছু শেষ করে ফেলছে।’
  
কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র সমবায় সমিতি সদস্য আজাদুর রহমান বলেন, ‘স্টিল বডির ট্রলিংগুলোর দেখাদেখি এখন কাঠের তৈরি ট্রলারগুলো ট্রলিংয়ে রূপান্তর করা হয়েছে। এসব অবৈধ ট্রলিংগুলো সাগরের মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করে ফেলছে। ট্রলিংয়ের জালে মাছের পোনাগুলো ঠিকতে পারছে না, ডিমের রেনুগুলো মারা যাচ্ছে। আর ছোট ছোট মাছগুলো তারা আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে না তাতে মনে হচ্ছে, সাগরের মৎস্য সম্পদ হুমকির মধ্যে রয়েছে।’
 
আজাদুর রহমান আরও বলেন, ‘ট্রলার মালিক প্রতিনিয়ত লোকসানের মধ্যে রয়েছে। ধার-দেনায় জর্জরিত। অনেকের লাখ লাখ টাকা ধার-দেনার কারণে সাগরে ট্রলার আর পাঠাচ্ছে না। এভাবে সাগরে ট্রলার না পাঠালে জেলেরা বেকার হয়ে পড়বে, কর্মস্থল বন্ধ হয়ে গেলে তখন তারা চুরি-ডাকাতিতে লিপ্ত হবে। সরকারের প্রতি দাবি থাকবে, দ্রুত সাগর থেকে অবৈধ ট্রলিংগুলো উঠিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করুন এবং মৎস্য সম্পদ রক্ষা করুন।’
 
উৎপাদনের বিপর্যয়: পরিসংখ্যান যা বলছে
 

কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ইলিশের অবতরণ প্রতিবছরই কমছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ অবতরণ হয়েছে ৩ হাজার ৯৭৫ মেট্রিক টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইলিশ অবতরণ হয়েছে ২ হাজার ৫৫৬ মেট্রিক টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অবতরণ হয়েছে ১ হাজার ৬২৮ মেট্রিক টন ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আগস্ট পর্যন্ত অবতরণ হয়েছে ২৬৭ মেট্রিক টন ইলিশ।
 

এখন ইলিশ যেন স্বর্ণের মতো
 

এক সময় কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ৩টি পন্টুনে জায়গা না পেয়ে ইলিশ রাখা হতো খোলা মাঠেও। এখন সেই পন্টুনে দেখা মিলছে মাত্র ৪০০-৫০০ ইলিশ। সেগুলোর দেখা পেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষায়, এখন ইলিশ যেন স্বর্ণের মতো, দামও সেই রকমই চড়া।
 
কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবসায়ী আব্দু রহিম বলেন, ‘আগে ৩-৪টা পন্টুনে ইলিশে সয়লাব হয়ে যেত। আর পন্টুনে ইলিশ রাখার স্থান পেয়ে মসজিদের খোলা মাঠে ইলিশ রেখে ব্যবসা করতাম। কিন্তু বতর্মানে এবছরে কক্সবাজারের অবস্থা ভাল না, ইলিশ নেই বললেই চলে। এক-দুইশ ট্রলার সাগরে গেলে ইলিশ নিয়ে আসে মাত্র ৪ থেকে ৫টা ট্রলারে। তাও ইলিশ পায় ২০০ থেকে ৫০০। এতে আমরা ব্যবসায়ীরা খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’
 
আরেক মৎস্য ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পুরো মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পন্টুনে দেখা যায় মাত্র ৪ থেকে ৫০০ ইলিশ। এগুলো নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা ঘিরে ধরে। আর এসব ইলিশের দাম আকাশচুম্বী।’
  
মৎস্য ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সাগরে দুর্যোগও বেশি, ট্রলিং বোটও বেড়ে গেছে। এখন ইলিশটা স্বর্ণের মতো হয়ে গেছে। এক কেজি ইলিশের দাম এখন ২ হাজার ৫০০ টাকার বেশি।’
 
কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মার্কেটিং কর্মকর্তা মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘চলতি বছর ইলিশ অবতরণ হয়েছে মাত্র ২৬৭ মেট্রিক টন, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। প্রতিবছরই ইলিশ অবতরণের পরিমাণ কমছে। যার কারণে রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে।
 
একসময় ইলিশ ছিল বাংলাদেশের সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির প্রাণ। এখন সেই ইলিশই সংকটে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি, অবৈধ ট্রলিং ও পোনা নিধনের কারণে সাগরে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সরকারের উচিত, দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সাগর থেকে অবৈধ ট্রলার অপসারণ করা ও ইলিশের প্রজনন মৌসুমে সঠিকভাবে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা। অন্যথায়, ‘ইলিশ’ শুধু বইয়ের পাতায় বা স্মৃতিতে রয়ে যাবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। উৎস: সময়নিউজটিভি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়