শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৩:২৯ রাত
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৯:১০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নতুন জানালা খুলছে উপশাখা ব্যাংকিং

বণিক বার্তার প্রতিবেদন।। দেশের আর্থিক খাতে কয়েক বছর ধরেই নানা সংকট চলছে। উচ্চ খেলাপি ঋণের চাপে অন্তত এক ডজন ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের চাহিদামতো আমানতের অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না। এ আস্থাহীনতার কারণে দেশের অনেক ব্যাংকের আমানত না বেড়ে উল্টো কমছে। তবে এ পরিস্থতির মধ্যেও ভালো করছে ব্যাংকের উপশাখা (সাব-ব্রাঞ্চ) মডেল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক তথা এপ্রিল-জুন সময়ে মূলধারার ব্যাংকিংয়ের চেয়ে উপশাখাগুলোর আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় চার গুণ বেশি। আর ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধিও ছিল সার্বিক প্রবৃদ্ধির সাত গুণ।

দেশের ব্যাংকগুলোর উপশাখা ব্যাংকিং নিয়ে গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের সামগ্রিক ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে উপশাখার মাধ্যমে সংগৃহীত আমানত বেড়েছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে বড় ধরনের স্থবিরতা চলছে। তবে উপশাখার ক্ষেত্রে এ চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এপ্রিল-জুন সময়ে ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক ঋণ প্রবৃদ্ধি যেখানে ১ দশমিক ৩ শতাংশ, উপশাখার মাধ্যমে সে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।

জনগণের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে ২০১৯ সালে দেশের ব্যাংকগুলোকে উপশাখা চালুর অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তারও এক বছর আগে কয়েকটি ব্যাংক ‘ব্যাংকিং বুথ’ চালু করেছিল। ব্যাংকিং বুথ স্থাপনের এ মডেলই পরবর্তী সময়ে উপশাখা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট কোনো শাখার অধীনে তিন-চারজন কর্মী নিয়ে ছোট পরিসরে উপশাখা চালু করছে। চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ৬২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৪৮টিই উপশাখা চালু করেছে। এ ব্যাংকগুলোর চালু করা উপশাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮০০টিতে। এর মধ্যে ৪৯ শতাংশই গ্রামীণ এলাকায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৮ হাজার ৭১ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছে উপশাখার মাধ্যমে, যেখানে আমানত হিসাবের সংখ্যা ছিল ৬৭ লাখ ৮১ হাজার ৮৭৪টি। একই সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে উপশাখার মাধ্যমে। এ ঋণের সুবিধাভোগী ব্যাংক হিসাব ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ৯০৪টি।

ব্যাংকগুলোর মোট ২ উপশাখার এক-চতুর্থাংশই আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসি চালু করেছে। দেশের বৃহত্তম ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক দাবি করা বেসরকারি এ ব্যাংকের উপশাখার সংখ্যা ১ হাজার ২২৫টি। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসি। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও পূবালী ব্যাংক পিএলসিও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপশাখা চালু করেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেন মনে করেন, উপশাখাগুলোর সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ার কারণেই সেখানে লেনদেনের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের প্রচলিত শাখাগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। এতে জনগণের বড় একটি অংশ আনুষ্ঠানিক আর্থিক সুবিধার বাইরে থেকে যায়। তুলনামূলক কম খরচ ও জনবল নিয়ে প্রান্তিক অঞ্চলে উপশাখা খুলে ব্যাংকিং সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায়। আবার মফস্বল এলাকাগুলোয়ও উপশাখাগুলো এমন স্থানে করা হয়, যেখানে “‌আনব্যাংকড” জনগণ বেশি। ফলে তারা ঘরের কাছেই খুব সহজে আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা নিতে পারছেন। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরাও ব্যাংকগুলোয় হিসাব খুলে টাকা জমা রাখছেন। আবার প্রবাসী আয়ের টাকাও এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সহজে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব কারণেই উপশাখাগুলো ভালো করছে। এ সেবা আরো বিস্তৃত করা গেলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে।’

ব্যাংকগুলোর চালু উপশাখার ২০ শতাংশই ঢাকা জেলায়। জুন পর্যন্ত ঢাকায় চালু করা উপশাখার সংখ্যা ছিল ৯৬৭। এর বাইরে উপশাখা স্থাপনের দিক থেকে এগিয়ে থাকা জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, নোয়াখালী, বগুড়া, খুলনা ও টাঙ্গাইল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চালু করা উপশাখার ৪৯ শতাংশই গ্রামীণ ও পল্লী এলাকায় বিস্তৃত। জুন শেষে উপশাখাভিত্তিক সংগৃহীত আমানতের ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশই ছিল গ্রামীণ এলাকার। এ সংখ্যা মার্চের তুলনায় দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। তবে আমানত বাড়লেও পল্লী এলাকায় উপশাখাগুলোর ঋণ বিতরণ কমেছে। গত মার্চ পর্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় উপশাখাগুলোর বিতরণকৃত ঋণের অংশীদারত্ব ছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। জুনে এসে সেটি ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেছে। উপশাখার মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের ১৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী উদ্যোক্তারা নিয়েছেন। যদিও উপশাখার মাধ্যমে সংগৃহীত আমানতের ২৬ দশমিক ৩ শতাংশই জমা দিয়েছেন নারীরা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের মূল ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের সিংহভাগই নগরকেন্দ্রিক। ব্যাংকগুলো বড় কিছু শাখার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এখন সেসব ঋণ আর ফেরত আসছে না। এর প্রভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। উপশাখার মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যাংকের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকগুলো যদি সে সুযোগ নিতে পারে, তাহলে দেশের গ্রামীণ কৃষি ও সিএসএমই খাত বড় ধরনের সুফল পাবে।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়