শিরোনাম
◈ সংবিধান সংস্কার থেকে নির্বাচনকালীন সরকার: রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ও যুক্তি কী বলছে? ◈ বাংলা‌দে‌শের বিরু‌দ্ধে সিরিজ জিতলো নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দল ◈ ভারত পা‌শে না থাকলে পিএস এ‌লে পা‌কিস্তা‌ন ক্রিকেট বো‌র্ডের  হাজার কোটি টাকার ক্ষতি ◈ গাজার একদিনে ১০০ লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের বিমান হামলা ◈ তিন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সমর্থন : প্রেস সচিব ◈ প্রধান উপদেষ্টার কাছে দুই বিষয়ে রোডম্যাপ চেয়েছে জামায়াত (ভিডিও) ◈ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ও তিন উপদেষ্টার অপসারণ দাবি বিএনপির ◈ প্রধান উপদেষ্টার কাছে এনসিপির ৫ দাবি (ভিডিও) ◈ যুক্তরাজ্যে সম্পদ জব্দের ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি: গভর্নর ◈ অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের শঙ্কা: জাতিসংঘ

প্রকাশিত : ২৫ মে, ২০২৫, ০৩:১৫ রাত
আপডেট : ২৫ মে, ২০২৫, ০৫:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সংবিধান সংস্কার থেকে নির্বাচনকালীন সরকার: রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ও যুক্তি কী বলছে?

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ‘পদত্যাগ ভাবনার’ গুঞ্জনে রাজনীতিতে সংকটের ঝুঁকি তৈরি হওয়ার পর বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তার সঙ্গে দেখা করে দায়িত্বে থাকার অনুরোধ জানালেও নিজেদের দাবিতে অনড় অবস্থান জানিয়ে এসেছে।

শনিবার রাতে তিন দলের বৈঠকের সময় উপস্থিত থাকা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মুহাম্মদ ইউনূস দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেননি। তিনি সবার কথা ধৈর্য সহকারে শুনেছেন, তবে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি।

এর আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক বৈঠকের পর উপদেষ্টা পরিষদের ‘অনির্ধারিত’ বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা চলে যাবেন–সে কথা বলেননি। তিনি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন।

এদিন সন্ধ্যায় প্রথমে বিএনপি, তারপর জামায়াত এবং সবশেষে এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।

বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার নিয়ে তিন দলই নিজেদের আগের অবস্থান তুলে ধরেছে। ফলে দলগুলোর অবস্থান সেই বিভক্তির জায়গায় রয়ে গেছে, যার কেন্দ্রবিন্দু ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন, যা বিএনপি দাবি করে আসছে।

বিএনপি বলেছে, ওই সময়ের মধ্যে যে নির্বাচন হবে, সেই প্রতিশ্রুতি তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পায়নি।

জামায়াত নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের পথনকশা চাইলেও কোনো সময়ের কথা বলেনি। তবে তারা আগের মতই নির্বাচনের আগে সংস্কারের ভাবনা জানিয়ে এসেছে।

অন্যদিকে এনসিপি বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচনের সঙ্গে জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জানিয়ে এসেছে। বলেছে, আওয়ামী লীগের সময়ের সব নির্বাচন আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে।

রোববার আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করবেন। তবে বর্তমান বাস্তবতায় প্রধান তিন দলের ভাষ্য ইতোমধ্যে তিনি পেয়ে গেছেন।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা প্রধান উপদেষ্টার এ উদ্যোগকে গত কয়েকদিন ধরে চলা অস্থিরতা প্রশমনের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন, তাতে তিনি কিছুটা হলেও সফল হয়েছেন কলে তারা মনে করছেন।

তবে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে যে মতভিন্নতা রয়েছে, সেটা কাটিয়ে উঠতে তারা দ্রুত নির্বাচনের পথনকশার গুরুত্বও তুলে ধরেছেন। বলেছেন, তা হলে নতুন নতুন দাবি আসতেই থাকবে, যা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

প্রেক্ষাপট:  গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের অনুরোধে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে ফ্রান্স থেকে ছুটে আসেন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।

গত ১০ মাসে বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা হলেও ইউনূস সরকারকে বড় কোনো বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন মিয়ানমারে ‘মানবিক করিডোর’ এবং বন্দর টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে সরকারের অবস্থানের কঠোর বিরোধিতা করেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার ও জুলাই ঘোষণা, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য চলছে।

তার আগে ‘মব’ সৃষ্টি করে বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতির মত ঘটনাতেও সরকার সমালোচিত হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

জুলাই আন্দোলনের ঐক্য মাস কয়েক বজায় থাকলেও প্রথমে ছাত্রদের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। তারপর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের দূরত্ব তৈরি হয়।

এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র আন্দোলন ও তাদের জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন দল এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে মিত্র দলগুলোর মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হতে শুরু করে।

রাজপথ দখলে নিয়ে টানা বিক্ষোভ দেখিয়ে এনসিপি যে কৌশলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আদায় করে নিয়েছে, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন সেই একই কৌশলে মেয়র পদে বসার চেষ্টা করলে এনসিপি সঙ্গে বিরোধ বাড়তে শুরু করে।

ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে এক সপ্তাহ আগে নগর ভবনের সামনে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন তার সমর্থকরা। পরে তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের কাছে কাকরাইলে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান।

সে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ইশরাক স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করেন।

অন্যদিকে ইশরাককে মেয়র ঘোষণার গেজেট প্রকাশ করায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এনসিপি। কমিশন পুনর্গঠন দাবি করে তারা নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভও করে।

সেখানে দলটির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী পরিকল্পনা উপদেষ্ট ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ‘বিএনপির মুখপাত্রা’ আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেন।

বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের তারিখ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য কথিত করিডোর ও বিদেশি কোম্পানিকে সমুদ্র বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য দেন।

এতে করে সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিরোধের বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বৃহস্পতিবার বিএনপি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে স্থানীয় সরকার, তথ্য ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেয়।

এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের’ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

তিন দলের সঙ্গে বৈঠক: শুক্রবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের আমন্ত্রণ পায় বিএনপি ও জামায়াত। শনিবারের এ বৈঠক সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এদিন সংবাদ সম্মেলন ডেকে এনসিপি তাদের দাবি তুলে ধরে। তারপরে দলটির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের সূচি জানা যায়।

রাতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় তিন দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে বসেন তিনি।

বিএনপি বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন ও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পথনকশা দাবি করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের বিচার ও সংস্কারকে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে দলটি, যা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের সময়ও করা সম্ভব বলে তারা মনে করে।

রাত পৌনে ৮টা থেকে প্রায় ৫০ মিনিটের বৈঠক শেষে বিএনপির চার নেতার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনের রোডম্যাপের ঘোষণা দেওয়া হলেই শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।”

নিরাপত্তা ও দুই ছাত্র উপদেষ্টা পদত্যাগের দাবির বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরার বিষয়টি জানান দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ।

জামায়াতে ইসলামীর দুই নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাংবাদিকদের সামনে আসেন শফিকুর রহমান। বলেন, দুটো রোডম্যাপ হলে বাকি সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, “জনগণের কোনো ভোগান্তি না হয়, এমন একটি সুবিধাজনক সময়ে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারের দৃশমান বিষয় জনগণের সামনে আসতে হবে।”

রাত পৌনে ১০টার দিকে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের নিয়ে গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে বৈঠকে বসেন মুহাম্মদ ইউনূস। ১০টা ১০ মিনিটের দিকে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন দলের নেতা নাহিদ ইসলাম।

তিনি বলেন, প্রতিশ্রুত ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এ দাবির বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।

শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার ধীরগতি দূর করতে বলেছে এনসিপি। সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা যেন নিশ্চিত করা হয়, সেই আহ্বান জানিয়েছে।

শেখ হাসিনার আমলে হওয়া সকল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন আইন করে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করতে বলেছে এনসিপি।

নাহিদ বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর তারা আর আস্থা রাখতে পারছে না। এই কমিশন পুনর্গঠন করে যেন দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা হয়।

আর জুলাই গণহত্যার বিচার; রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়া ও জুলাই সনদ ঘোষণা এবং গণপরিষদ ও আইনসভা নির্বাচন– এই তিনটি বিষয়ে সমন্বিত একটি পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রধান উপদেষ্টার কাছে চেয়েছে এনসিপি।

‘বিকল্প আপনারাই খুঁজে নেবেন’: বৈঠক উপস্থিত থাকা প্রধান উপদেষ্টা দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপি জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের খবরে তারা গভীর উদ্বিগ্ন। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আপনি পদত্যাগ করলে আমরা তো বড় রকমের সংকটে পড়ে যাব! কেন আপনি এ ধরনের চিন্তা করছেন? আপনার বিকল্প কী হবে?’ জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিকল্প আপনারাই খুঁজে নেবেন’।

“তবে বিএনপি নেতারা অনুরোধ করেন, ‘এ ধরনের কথা অনুগ্রহ করে বলবেন না। আপনি যেন দায়িত্বে বহাল থাকেন, আমরা তা নিশ্চিত করতে চাই। আপনাকে আমরা সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব’।”

ওই কর্মকর্তা বলেন, “জামায়াতের তরফেও হতাশা প্রকাশ করা হয়। দলটি উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করে বলেন, ‘আপনি যেন বিরক্ত না হন বা দায়িত্ব ছেড়ে না দেন’। জামায়াতের পক্ষ থেকেও যে কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।”

তিনি বলেন, “এনসিপি জানায়, তারা প্রধান উপদেষ্টার পাশে থাকবে এবং প্রয়োজনে পুনরায় রাজপথে নামতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা তাদের বলেন, ‘না না, রাজপথে নামার প্রয়োজন নেই’।”

এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের অভিপ্রায় নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে। সেখানে এনসিপি কী বলেছে তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।

উত্তরে নাহিদ বলেন, “আমরা বলেছি যে উনি যাতে দায়িত্বে থাকেন, দায়িত্ব থেকে রাজনৈতিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে সকল পক্ষের সকল সমস্যার সমাধান করেন। কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং জনগণ এবং যে গণঅভ্যুত্থানকারী ছাত্রজনতা, তাদের আহ্বানেই তিনি দায়িত্বে এসেছেন এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই তিনি আসলে কমিটেড, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি উনি কমিটেড নয়, এ বিষয়টা যাতে উনি বিবেচনা করেন যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে।”

কী কারণে ইউনূস সরে যেতে চান, সেই প্রশ্নে এনসিপি নেতা বলেন, “উনি কাজ করতে পারছেন না, বা উনি দায়িত্ব ছেড়ে দিবেন কিনা, এ বিষয়ে উনার চিন্তা ভাবনা রয়েছে। এটা তো অলরেডি মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়ায় এসেছে। তো সেই প্রেক্ষিতেই আজকের এই বৈঠক।”

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেননি। তিনি সবার কথা ধৈর্যসহকারে শুনেছেন, তবে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি।

“গত দুই-তিন দিন ধরে তিনি খুব একটা কারো সঙ্গে কথা বলেননি, এমনকি তার মুখে হাসিরও দেখা পাননি তার আশেপাশে যারা থাকেন তারা। সবসময় তিরি গভীর দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সকালে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তার সহকর্মীরা এরকম নিশ্চয়তা পাননি যে তিনি পদত্যাগ করবেন না।”

তবে একনেক বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের’ গুঞ্জন উড়িয়ে দেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

“উনি তো চলে যাবেন- বলেননি। উনি বলেছেন যে, ‘আমরা যে কাজ করছি, আমাদের উপরে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে দায়িত্ব পালনে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে; কিন্তু আমরা সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব, এটা তো বড় দায়িত্ব, এটার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ, বহুবছরের ভবিষ্যৎ, এ দায়িত্ব ছেড়ে তো আমরা যেতে পারব না’।”

পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “আমরা প্রত্যেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে কী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, কার কী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সংস্কার কাজ আমরা এগিয়ে নিতে গেলে কী হচ্ছে, সেগুলো আমরা দেখছি।”

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, উপদেষ্টাদের নিয়ে ‘বিতর্ক’ সমীচীন হবে না।

বিকালে উপদেষ্টা পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, “যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসম্মুখে তুলে ধরে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।”

এতে বলা হয়, “দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ।”

অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় তিনটি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে ধারণা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

‘চাপের মুখে সরকার, নির্বাচনে স্বস্তি’: তিন দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর তার সারসংক্ষেপ জানাতে এসে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। দলগুলো তার অধীনেই নির্বাচন চেয়েছে। তিনি দলগুলোকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক বিষয়ে জাতীয় নির্বাচন পযবেক্ষক পরিষদ-জানিপপ চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিবন্ধিত অনিবন্ধিত অনেক দল রয়েছে। তিন দলের সঙ্গে এ আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না।”

সরকার যে ‘চাপের মুখে’ পড়েছে, সেটা যাতে উপশম করা যায় সেজন্য এ অবস্থান তারা নিয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।

ভোটকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের দাবি দাওয়া এবং সেগুলো একটা জায়গায় নিয়ে আসা ‘এ রকমের বাজিকর অধ্যাপক ইউনূস নন’ বলেও মন্তব্য করেন কলিমউল্লাহ।

রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন যে বিশৃঙ্খল অবস্থা, এলোমেলো অবস্থা, আমার মনে হয় শুরুতে আমরা একটু ভুল করে ফেলেছি। ভুলটা এরকম- অন্তর্বর্তী সরকার কী কাজ করবে, তাতে একটা ফাঁক রয়েছে।”

বিএনপিসহ কয়েকটি দলের তরফে বলা হচ্ছে, এ সরকার অনির্বাচিত, নির্বাচন দেওয়া ছাড়া এ সরকারের অন্য কোনো কাজ নেই। অপর দিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটা কাজ।

আব্দুল আলীম মনে করেন, এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি রয়ে গেছে। এই দূরত্বটা সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুতেই দূর করা দরকার ছিল, যা করা হয়নি।

দলগুলো সরকারকে সহায়তা না দিলে একটা অনিশ্চিত অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। দলগুলোর সহযোগিতা পেতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আব্দুল আলীম।

তিনি বলেন, “যেহেতু সব সংস্কার নির্বাচনের আগে সম্ভব নয়, অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারে মনোযোগ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে সরকার সংকটে পড়েছে তা প্রধান কারণ নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের মতামত ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার করিডোর ও বন্দর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন একমাত্র গণতান্ত্রিক সমাধান হচ্ছে নির্বাচন। সরকার দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সবার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ, সামান্য বিভেদ লক্ষ্যণীয় ছিল গত কয়েকদিন ধরে, সেটা আজকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার, আলোচনার মধ্য দিয়ে কমে এসেছে।”

তার মতে, এ সরকার সংকট উত্তরণের জন্য এসেছেন। এখানে তিনটা কাজকে প্রাধান্য দিতে হবে।

“নির্বাচনের রোডম্যাপ সবসময়ই অগ্রাধিকার। কারণ, এ সরকারকে তো বের হতে হবে। বের হতে হলে তার অবশ্যই একটা ডেডলাইন থাকতে হবে, নির্বাচন কবে করবেন এবং কীভাবে করবেন। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের দাবি জবাবদিহিমূলক সরকার গঠন, সে জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে এগিয়ে নিতে হবে। এছাড়া আছে বিচারের দাবি, ন্যায় বিচারটাকে দৃশ্যমান করতে হবে।” উৎস: বিডিনিউজ২৪

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়