নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। এটি ইমানদারের জন্য প্রতিদিন পাঁচবার আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ। কিন্তু মানুষ তো দুর্বল—ভ্রমণ, অসুস্থতা, ব্যস্ততা কিংবা অমনোযোগের কারণে কারও কারও নামাজ বাদ পড়ে যায়। এ বাদ পড়া নামাজকে ইসলাম পরিত্যক্ত রাখার অনুমতি দেয়নি; বরং তা পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামি পরিভাষায় একে বলা হয় কাজা নামাজ।
কাজা নামাজ কেন জরুরি
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন: “যে ব্যক্তি নামাজ ভুলে যায় বা ঘুমিয়ে পড়ে, তার কাফফারা হলো, যখন মনে পড়বে তখনই নামাজ আদায় করা।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৮৪)
অর্থাৎ, নামাজ বাদ পড়ে গেলে সেটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় না। মনে পড়ামাত্রই তা পূর্ণ করতে হবে। এজন্য আলেমরা একমত হয়েছেন—ফরজ নামাজ ও ওয়াজিব নামাজ (যেমন বিতর) বাদ পড়লে তা কাজা করা ফরজ।
কোন নামাজ কাজা করতে হয়?
ফরজ নামাজ : পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ যদি বাদ যায়, তা কাজা করতে হবে।
ওয়াজিব নামাজ : বিতর নামাজও কাজা করতে হবে।
নফল নামাজ : এর কাজা নেই।
কাজা নামাজ আদায়ের পদ্ধতি
১. নিয়ত করা: যেমন, “আমি অমুক দিনের যোহরের ফরজ নামাজ কাজা করার নিয়ত করছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”
২. সময়: কাজা নামাজ দিনের বা রাতের যেকোনো সময়ে পড়া যায়। তবে তিনটি সময়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ— সূর্যোদয়ের সময়, দুপুরে সূর্য মাথার ওপরে থাকা অবস্থায়, সূর্যাস্তের মুহূর্তে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৩১)
৩. ক্রমানুসরণ (তারতিব): যদি অনেক দিনের নামাজ জমা হয়ে যায়, তখন ধারাবাহিকভাবে পড়া জরুরি নয়। তবে এক-দুই দিনের নামাজ বাদ গেলে, ক্রমানুসারে আদায় করা উত্তম।
৪. কতটা পড়তে হবে: যে নামাজ বাদ গেছে, শুধু সেই পরিমাণ পূর্ণ করতে হবে। যদি বহু বছরের নামাজ বাদ পড়ে, তবে প্রতিদিন ফরজ নামাজের পর একটি করে কাজা পড়া বা আলাদা সময় ঠিক করে আদায় করা ভালো।
চার মাযহাবের দৃষ্টিতে কাজা নামাজ
হানাফি মাযহাব: কাজা নামাজ আদায় করা ফরজ। ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত, সব নামাজ কাজা করতে হবে। (ইবনুল হুমাম, ফাতহুল কাদির, খণ্ড ১, পৃ. ৩৬৭)
শাফেয়ি মাযহাব: বাদ পড়া নামাজ অবিলম্বে আদায় করা জরুরি। (ইমাম নববী, আল-মাজমু‘, খণ্ড ৩, পৃ. ৬৯)
মালিকি মাযহাব: কাজা নামাজ জরুরি, তবে ধীরে ধীরে করলেও চলবে।
হাম্বলি মাযহাব: ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ বাদ দেওয়া মহাপাপ, কিন্তু কাজা করাই তার দায়িত্ব। (ইবন কুদামা, আল-মুগনি, খণ্ড ২, পৃ. ৭৩)
কোরআনের আলোকে কাজা নামাজ
আল্লাহ বলেন: “নামাজ কায়েম করো আমার স্মরণের জন্য।” (সুরা ত্ব-হা, আয়াত: ১৪)
তাফসিরকারগণ বলেন, এ আয়াতের ভেতরে ইঙ্গিত রয়েছে—যদি নামাজ বাদ পড়ে যায়, তবে স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে তা আদায় করতে হবে (ইবন কাসীর, তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, খণ্ড ৫, পৃ. ২৮৫)।
কিছু বিশেষ নির্দেশনা
১. ভুলে যাওয়া বা ঘুমিয়ে পড়া: মনে পড়ামাত্রই নামাজ আদায় করতে হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৮৪)
২. ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া: এটি মহাপাপ। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং বাদ পড়া নামাজগুলো পূর্ণ করতে হবে।
৩. বহু বছরের নামাজ জমা হলে:ধীরে ধীরে আদায় করার পরিকল্পনা করা জরুরি। যেমন—প্রতিটি ফরজ নামাজের সাথে এক বা একাধিক কাজা পড়া।
বাস্তব জীবনে শিক্ষা
আজকের ব্যস্ত জীবনে অনেক মুসলমানই নামাজ অবহেলা করে। কিন্তু কাজা নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ এখনো খোলা আছে। এটা হলো আল্লাহর অসীম দয়া। তবে মনে রাখতে হবে—নামাজকে হালকাভাবে নেওয়া মারাত্মক গুনাহ। কাজা নামাজ আদায় করা মানে কেবল বাদ পড়া ফরজ পূর্ণ করা নয়, বরং এটি নিজের আত্মাকে নতুনভাবে আল্লাহর সামনে সোপর্দ করার এক সুযোগ। উৎস: প্রথম আলো