মাহদী মাহমুদ: বর্তমান জামানায় কারবালার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। রাসূলের প্রসিদ্ধ হাদিসে আছে, "হাসান ও হোসাইন জান্নাতের যুবকদের সর্দার", "হোসাইন আমার থেকে, আর আমি হোসাইন থেকে", "হোসাইন হচ্ছে নূহের কিস্তি (নৌকা) এর মত, যে এতে আরোহণ করলো সে নাজাত পেলো।" আরো বলেছেন, "কুরআন ও আহলে বায়েতকে অনুসরণ করো, কারণ এ দুইটি কেয়ামত পর্যন্ত পরস্পর থেকে আলাদা হবেনা।" আর ইমাম হোসাইন ছিলেন আহলে বায়েতের সদস্য।
ইসলামে বংশীয় অহেতুক ভক্তিবাদের অপচয় বা বাহুল্য নেই। বরং কুরআনে নূহ নবীর সন্তানের দৃষ্টান্ত এনে দেখানো হয়েছে, এমনকি নবীর সন্তানও বিপথগামী হতে পারে। অন্যদিকে শেষ নবী রাসূলে আকরামের জীবদ্দশায় ইমাম হোসাইন ছিলেন শিশুমাত্র। তাই অবশ্যই ইমাম হোসাইন রাসূলের ওফাতের পর ইসলামের জন্যে বিরাট অবদান রেখেছেন, যার কারণে তিনি জান্নাতের যুবকদের নেতা (যেহেতু রাসূলে পাক বাহুল্য কথা বলেন না)।
আদতেই তাই। রাসূলের ওফাতের অব্যবহিত পরেই রাসূলের বিধানকে অবমাননা করে নিজস্ব বিধান চাপিয়ে দেয়ার যে জুলুম শুরু হয়, তার বিরুদ্ধেই ছিল ইমাম হোসাইনের বিপ্লব এবং সংস্কার কার্যক্রম। তাই তিনি বলেছিলেন, "আমি ফিতনা সৃষ্টির জন্যে বের হইনি। বরং বেরিয়েছি আমার নানা নবী মোহাম্মদের (সা.) দ্বীনকে ফিরিয়ে আনতে। এই উম্মতের সংস্কার করতে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে।"
কারবালার প্রাসঙ্গিক উপাদানসমূহ: কারবালা মানব ইতিহাসে একটা ট্রাজেডি, একটা বিপ্লবের চিহ্ন, একটা রেজিস্ট্যান্স হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। মোটামুটি দুটো প্রেক্ষিত দিয়ে কারবালার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরা যায়—নেতিবাচক ও ইতিবাচক। প্রথমে নেতিবাচক প্রেক্ষিতসমূহ এবং এর পরে ইতিবাচক দিকগুলো আলাপের চেষ্টা করা হচ্ছে।
পানি সন্ত্রাস: সিফফিনের যুদ্ধের সময় আমিরুল মু’মিনীন ইমাম আলী পানির কূপগুলো দখল করার পর তার পক্ষের সেনারা বললেন, "আমরা মুয়াবিয়ার বাহিনীকে পানি দেব না। পানি অবরোধ দিয়ে মারব।" ইমাম বললেন, “না। এ কাজ শরিয়তসম্মত নয়। এ কাজ আমাদের দ্বারা হওয়াটা এথিক্যাল নয়। শত্রুদের পানি পানের উপর কোনো রকম বাধা প্রদান করা যাবেনা। তাদের এ অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। কারবালা ময়দানে আসার পথে রাস্তায় যখন ইয়াজিদের পক্ষে হযরত হুর পথ রোধ করে, তখন তার সেনাদলটি ছিল পিপাসার্ত। ইমাম হোসাইন তাদের সব মশক নিয়ে এসে হুর বাহিনী এবং তার ঘোড়াগুলোকে পানি পান করাতে নির্দেশ দেন।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কারবালার ময়দানে প্রবেশের পর মাত্র দেড়শ'র মতো সদস্যের ইমামের বাহিনীকে পরাজিত করার জন্যে চার হাজার তীরন্দাজ সেনা দিয়ে ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদকে ঘেরাও করে জালিম উমাইয়া বাহিনী। এমনকি তারা ইমামের ৬ মাসের শিশু আলী আজগরকেও পানি না দিয়ে তীর ছুঁড়ে হত্যা করে।
এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা কি আমরা এই যুগে দেখতে পাচ্ছি না? একবিংশ শতাব্দীতে এসে বলদর্পী রাষ্ট্র কর্তৃক মজলুম রাষ্ট্রগুলোকে অত্যাচার এবং নতি স্বীকার করানোর সবচেয়ে প্রবল এবং নিদারুণ অস্ত্র হচ্ছে ‘পানি সন্ত্রাস’।
আধুনিক বিশ্বে ‘পানি সন্ত্রাস’ একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বলি হচ্ছে কোটি কোটি নিরীহ মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা ও ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমিয়ে দিয়ে কৃষি ও জীবিকা ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, আবার বর্ষাকালে হঠাৎ অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে সৃষ্টি করছে ভয়াবহ বন্যা। এতে প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে, যেন বাংলাদেশ নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উপর পানি সন্ত্রাসের এক নির্মম উদাহরণ স্থাপন করেছে—ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের মাথাপিছু পানি প্রাপ্যতা যেখানে মাত্র ৫০–৭০ লিটার, সেখানে ইসরায়েলিরা পাচ্ছে ২৫০–৩০০ লিটারের বেশি। গাজা ও পশ্চিম তীরের অধিকাংশ পানির উৎস দখল করে ইসরাইল তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পানির পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, যাতে সাধারণ মানুষ দুর্বল ও অসহায় হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়াতেই আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ভারতের ইন্দাস পানি চুক্তি লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি—বিভিন্ন ড্যাম ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত সিন্ধু নদের পানি আটকে রেখে কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিশোধমূলক কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে তুরস্ক দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে GAP Project-এর আওতায় ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর উৎসস্থলে বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করে সিরিয়া ও ইরাকের পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশদ্বয়ে কৃষি, খাবার পানি ও পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
এইসব উদাহরণ প্রমাণ করে, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে পানি হয়ে উঠেছে আধুনিক আগ্রাসনের এক নীরব কিন্তু নিষ্ঠুর অস্ত্র।
ইসলামের যুদ্ধনীতিতে প্রকৃতি, জলাধার/পানির উৎসের ক্ষতিসাধনের অনুমতি নেই। আর সেই যুদ্ধনীতি অনুসরণ করার কারণেই, ইরান সাম্প্রতিক যুদ্ধে ইসরায়েলে অবস্থিত সুপেয় পানি তৈরির প্লান্টে মিসাইল হামলা চালায়নি, যদিও সেটা করার মাধ্যমে ইসরায়েলকে চরমভাবে পর্যুদস্ত করা যেতো।
গণহত্যা এবং শিশুহত্যা: কারবালা ছিল এক প্রবল এবং তাৎপর্যপূর্ণ গণহত্যা। সংখ্যার দিক থেকে বিরাট না হলেও, তাৎপর্য বা মানগতভাবে প্রবলতম গণহত্যা। রাসূলে পাকের মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছর না যেতেই কী করে তাঁর নিজের নাতিকে—যাকে জান্নাতের যুবকদের নেতা হওয়ার ঘোষণা দিয়ে গেছেন স্বয়ং নবী—সপরিবারে, কোলের শিশু সহকারে হত্যা করলো নবীর নিজেরই উম্মত? এই এক ঘটনা এবং ছয় মাসের শিশুর রক্তপাতই কারবালার ময়দানে হক এবং বাতিলকে সাদা-কালো করে দেয়, কোনোরূপ ‘অস্পষ্টতা’র সুযোগ নিঃশেষ করে দেয়।
উম্মতের অধঃপতন কীভাবে এই জায়গায় এসে পৌঁছলো যে, সত্য নবীর জান্নাতি নাতিকে জবাই করে হত্যা করা হলো? এই জালিম বাহিনী কি রাতারাতি মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে? নামাজ-রোযা-তাহাজ্জুদগুজার এই উম্মত কী করে জান্নাতের নেতাকে হত্যা করলো? এবং জান্নাতের নেতার পক্ষাবলম্বন না করে, ‘সাহাবী’গণ কীভাবে মদিনা এবং মক্কায় বসে রইলো? কীভাবে এই পঞ্চাশ বছরে নবীর সুন্নতকে পদদলিত করা হলো এবং কুরআনকে বর্শার আগায় উঠিয়ে রাজনীতির অস্ত্রে পরিণত করা হলো—যেই ধর্মব্যবসায়, জুলুম এবং অন্যায়ের সংস্কার করতে গিয়ে শহীদ হতে হলো আল হোসাইনকে?
জান্নাতের নেতাকে হত্যাকারী জালেম বাহিনী এবং যারা এই জুলুমের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, তাদেরকেও কি আমরা জান্নাতি মনে করব? নাকি তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ? আমাদের হক-চিন্তার মানদণ্ড কিন্তু কারবালার সেই গণহত্যাই ঠিক করে দিয়েছে, যেখানে হোসাইন সপরিবারে শহীদ হয়েছেন এবং তাঁর স্ত্রী-কন্যাগণ নিপীড়িত হয়েছেন।
জুলুম: কারবালার প্রেক্ষাপট সৃষ্টিকারী এবং কারবালার বৃহৎ ক্যানভাসে জুলুমের ধরন ছিল মাল্টি-ডাইমেনশনাল। মানব সমাজে সবচেয়ে বড় জুলুম ব্যক্তিগত এবং সামাজিক/প্রকাশ্য গুনাহ; গুনাহের নরমালাইজেশন। আর এগুলো চূড়ান্ত রূপ লাভ করে বনি উমাইয়া—বিশেষত ইয়াজিদের আমলেই। উমাইয়া আমলে সমকামিতা, অবৈধ যৌনাচার, অযাচার, মদ্যপান, সুদ খাওয়া, অর্থের বিনিময়ে অপবাদ আরোপ, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, ক্যাডারবাজি, জাল হাদিস বানানো, ইসলামী শরিয়তের ইসরায়েলিকরণ (ইহুদি-খ্রিষ্টান ধর্মের শরিয়ত ইসলামের মধ্যে ঢোকানো)—এরকম কাজগুলোকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয় এবং পরিপূর্ণ দ্বীনকে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ এর মতো বস্তুগত চর্চায় পরিণত করা হয়।
সবচেয়ে বড় পচন ঘটে আলেম সমাজের। আলেম সমাজ খুব স্বাভাবিকভাবেই রাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে যায়। আর, তারাই ইমাম হোসাইনের রক্ত ঝড়ানোকে হালাল/জায়েজ/করণীয় ফতোয়া দেয়। "শাসক নিপীড়ক হলেও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা যাবেনা", "শাসক ঈশ্বরের প্রতিচ্ছায়া", "শাসক এবং শাসিত, শোষক এবং শোষিত এগুলো নিয়তির বিধান, তাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবেনা"—এরকম ন্যারেটিভগুলো উমাইয়া আমলের আলেমেরাই চালু করে, যেগুলো আজকের যুগেও ইসলামের ভেতর থেকে পচনের কারণ হিসেবে বহাল রয়েছে। যার ফলে মজলুম ফিলিস্তিনিরা নিপীড়িত হয়েই চলেছে, আর আরব শাসক এবং তাদের আলেমেরা "আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান)-দের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন—আব্রাহাম একর্ড—এর চুক্তি করছে, তাও আবার ষাট হাজার ফিলিস্তিনির লাশের উপরে দাঁড়িয়ে।
লাশের অবমাননা, নারী নির্যাতন এবং অপপ্রচার: কারবালার হত্যাকাণ্ডকে চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয় শহীদদের লাশের অচিন্তনীয় অবমাননার মাধ্যমে। উমাইয়া বাহিনী কারবালার শহীদগণের লাশকেও ভয় পেত। তাদের পোশাককেও ভয় পেত। তাদের ছুঁতেও ভয় পেত। আর তাদের নৈতিক অবস্থা এতটাই নাজুক অবস্থানে চলে গিয়েছিল যে, তারা এমনকি জান্নাতের যুবকদের নেতার লাশ থেকে আঙুল কেটে আংটি, পোশাক এবং তার কন্যার কান ছিঁড়ে কানের দুল চুরি-ডাকাতি করে নিয়ে যায়।
শুধু তাই নয়। ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারকে বেত/কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করে ইয়াজিদ।
ইবনে কাসির – আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-য় লেখেন, "ইয়াজিদ তার সামনে থাকা একটি কাঠি দিয়ে হুসাইনের ঠোঁট ও দাঁতের উপর আঘাত করেছিল এবং বলেছিল, 'কি সুন্দর দাঁত!" ইবনে আসাকির – তারিখে দিমাশক-এ লেখেন, "ইয়াজিদ মুখে এমন কিছু বলেছিল, যা তার কুফরের লক্ষণ প্রকাশ করে। সে ইমাম হোসাইনের মাথার উপর কাঠি মেরে কাব্য আবৃত্তি করে বলেছিল,
لَعِبَتْ هاشِمُ بِالْمُلْكِ، فَلا خَبَرٌ جاءَ، وَلا وَحْيٌ نَزَلَ
অর্থ: “হাশিম বংশ রাজত্ব নিয়ে খেলা করেছে; (আসলে) কোনো ওহি অবতীর্ণ হয়নি, কোনো খবর (আসমানী বার্তা) আসেনি।”
কারবালার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরে নারী ও শিশুদের বেত্রাঘাত করা হয়। নারীদের মাথার চাদর কেড়ে নিয়ে বাজারে বাজারে ঘোরানো হয় এবং তাদেরকে কাফের, ইসলামত্যাগী, ফিতনাকারী, বিদ্রোহী, ইসলামের শত্রু, মুশরিক ইত্যাদি ফ্রেমিং করে ফ্যাসিবাদী কায়দায় অপপ্রচার চালানো হয়। তবে উমাইয়াদের এই ডিফেইমেশন ক্যাম্পেইন নতুন কিছু ছিল না এবং এমন নয় যে কারবালার পরে সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
কারবালার প্রাক্কালে উমাইয়া শাসনযুগে ইমাম আলীর বিরুদ্ধে গালি ও অপপ্রচারের এক সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন আমীরে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, আমীরে মুয়াবিয়া সাহাবি সা‘দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কেন আবু তুরাব (আলী)-কে গালি দাও না?”—এটি প্রমাণ করে, মুয়াবিয়া চেয়েছিলেন ইমাম আলীকে গালি দেয়া হোক এবং সেটি প্রচলিত হোক। অপরদিকে, ইমাম নাসাঈ সিরিয়ার এক মসজিদে ইমাম আলীকে মিম্বর থেকে গালি দিতে শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর ফজিলত নিয়ে বই লিখলে উমাইয়া পক্ষের লোকেরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তৃতীয়ত, বিখ্যাত ঐতিহাসিক তাবারী বর্ণনা করেন যে, আমীরে মুয়াবিয়া ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন মসজিদে রাষ্ট্রীয়ভাবে মিম্বর থেকে ইমাম আলীকে গালি দেয়া বাধ্যতামূলক করেন, যা তার গভর্নরদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়—যেমন মারওয়ান ইবনে হাকাম ও জিয়াদ ইবনে আবিহি। এই ঘটনাগুলো একদিকে যেমন ইসলামী ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়, অন্যদিকে তা কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে ইয়াজিদি জুলুমের আদর্শিক ও রাজনৈতিক ভূমি প্রস্তুত করেছিল।
কারবালার পরেও উমাইয়াপন্থীরা ইমাম হোসাইনের অনুসারীদের নামে শিরক, অতিরঞ্জন, তাকিয়্যা, মিথ্যাচার করার অপবাদ আরোপ করে এবং ইমামগণের অনুসারী (শিয়া) দের পারিভাষিক নাম ‘শিয়া’ কে একটা গালি এবং পলিটিকাল bully তে পরিণত করে, যা আজবধি চলমান আছে এবং ইসলামকে খণ্ড-বিখণ্ড করে রেখেছে।
কারবালা যুদ্ধের নৃশংসতা, গণহত্যা ইসলামের যুদ্ধনীতিকে অনুসরণ করেনা, বরং আজকের যুগের জায়নবাদী ইসরায়েলের দাহিয়া নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখা যায়। জনমনে অসন্তোষ এবং ভীতি সৃষ্টির জন্যে নৃশংসতার পথ অবলম্বন এবং শিশুদের হত্যা করার নৃশংসতার এই ‘সভ্য’ এবং ‘শিক্ষিত’ ধরনটি আমরা মার্কিন এবং ইসরায়েলের যুদ্ধনীতিতে হামেশাই দেখতে পাই।
কারবালার প্রেক্ষাপট তৈরিতেও এই একই বিষয়গুলোই দেখতে পাই। কারবালার পূর্বেও উমাইয়া এবং উমাইয়াপন্থীরা নবী বংশের প্রতি ক্ষোভ থেকে রাসূলের সাহাবীদের জিহ্বা কেটে ফেলা, আগুনে পুড়িয়ে মারা, লাশ ঝুলিয়ে রাখা এবং তাদের নামে ইসলামত্যাগের/মুরতাদ হয়ে যাওয়ার অপবাদ দিয়ে জবাই করা এবং তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করার মত কাজ করেছে।
একই রূপ আমরা দেখতে পাই ফেরাউনের জমানায়, মূসা নবীর জন্ম ঠেকানোর জন্যে হাজার হাজার শিশু নিধনের ঘটনায়। কিংবা নবী পরিবার থেকে ইমাম মাহদীর আগমন ঠেকানোর জন্যে নবী পরিবারের প্রতি আব্বাসীয় আগ্রাসন থেকেও।
কারবালার সংগ্রামের একটি বিরাট ইতিবাচক ক্যানভাস রয়েছে। যা উমাইয়া বাহিনীর এত সব কালিমালিপ্ত ঘটনার মধ্যে দীপ্ত, জাজ্জ্বল্যমান, হুজ্জাত (প্রমাণ্য) হয়ে রয়েছে, যা কেয়ামত পর্যন্ত যেকোনো সত্য সন্ধানীকে পথ দেখাবে।
কারবালা ছিল সর্বাগ্রে একটা সংস্কার আন্দোলন। ইসলামের শাসনব্যবস্থার ঐশী স্বরূপ ফিরিয়ে আনার আন্দোলন। যে কেউ চাইলেই, কেবল সেনাপ্রধান, শক্তিমান, সবচেয়ে বয়স্ক হওয়ার দোহাই দিয়ে, ম্যাসাকার করে কিংবা ভোট জালিয়াতি করে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব গ্রহণ করে, ঈশ্বরের প্রতিচ্ছায়া সেজে না বসতে পারে তার জন্যেই এই সংগ্রাম, আন্দোলন, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ এবং সংস্কার চেষ্টা। রাসূল যে আশঙ্কা করেছিলেন যে, "বনি উমাইয়া রাসূলের মিম্বর নিয়ে খেলবে, রাসূলের মিম্বরে বানর চড়াবে" এবং এভাবে ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে হীন ও নিচে নামিয়ে মাটিতে মেশাবে, তার বিরুদ্ধেই ইসলামী রুহানী শাসন। মিশেল ফুঁকো যেটাকে ‘রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা’ বলেছিলেন, তারই জন্যে প্রথমবার কিয়াম করেছিলেন ইমাম হোসাইন। আর, এর পরিণতি দিয়েছেন ইরানে ইমাম খোমেনী ১৯৭৯ সালে।
ইমাম হোসেইনের সংগ্রাম ছিল ঘুণে ধরা, পঞ্চাশ বছরের গুনাহের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া মুসলিম উম্মাহর এসলাহ (সংশোধন), ইকামাতে দ্বীনের সংগ্রাম। ‘কালেক্টিভ উইল’ এর সংশোধনের লড়াই। সমাজে ছড়িয়ে পড়া সুদ-ঘুষ-স্বর্ণমুদ্রা নামের ‘দিরহামপূজার’ মূর্তিকে গুড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলন। রাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ এবং অপবাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন। যে আন্দোলনে তার সারথি হয়েছিলেন নারী, পুরুষ, শিয়ানে আলী (আলীর অনুসারী), উসমানের অনুসারী, খ্রিষ্টান, কৃষ্ণাঙ্গ দাস, আরব, ইরানি, ইয়াজিদ বাহিনীর অনুতপ্ত পাপী সেনাপতি, শিশু, কিশোর, ধর্মান্তরিত মুসলমান—সকলেই! এজন্যেই ইমাম হোসাইন বলতে পেরেছিলেন, “হে ইয়াজিদ বাহিনী! তোমরা যদি মুসলমান না’ও হয়ে থাকো, অন্তত স্বাধীন মানুষ হও!”
কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন ও তাঁর সাহাবীরা যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো কেবল ইতিহাসের শব্দ নয়—মানবতার চিরন্তন আদর্শ। ইমাম হোসাইন বলেছিলেন, “আমি মৃত্যুকে দেখি সফলতা হিসেবে, আর জালেমদের সাথে জীবনকে ঘৃণার যোগ্য বলে গণ্য করি।” তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দেন, “অপমান আমাদের থেকে বহু দূরে”—আমরা কখনোই লাঞ্ছনা মেনে নেব না। হযরত কাসেম বলেছিলেন, “আপনার সঙ্গে মৃত্যু আমার কাছে মধুর থেকেও মিষ্টি।”
হযরত হুর যখন তওবা করে ইমামের দলে যোগ দেন, তিনি বলেছিলেন, “আমি জানি আমি জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, আমি কখনোই জাহান্নামকে বেছে নিতে পারি না।” হযরত আবুল ফজল আব্বাস বলেছিলেন, “যদি তোমরা আমার দুই হাত কেটে ফেলো, তবুও আমি কখনোই তোমাদের ধর্মের পক্ষে থাকব না।”
সাহসী কিশোর হযরত আলী আকবর বলেছিলেন, “আমরা তো সত্যের পক্ষে। তবে মৃত্যু আমাদের কেন ভয় দেখাবে?”
আর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সাহাবি জন বলেছিলেন, “আপনি যখন সুখে ছিলেন, আমি আপনার পাশে ছিলাম—এখন আপনার দুঃখের সময়ে কি আপনাকে ছেড়ে যাব?” আর শাহাদাতের মুহূর্তে ইমাম হোসেইন বলেছিলেন, “হে আল্লাহ! আমি তোমার ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট, আর তোমার ইচ্ছার সামনে মাথা নত করছি।”