বিশ্ব মঞ্চে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সর্বশেষ খেলাটি খেলা হয়েছে নীতির গল্পের মতো। এই নৈতিকতা রক্তে লেখা ভণ্ডামি ছাড়া কিছু না। স্টুডিওর আলোয় গোসল করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ইরানি জনগণের ত্রাণকর্তার মুকুট পরিয়েছেন। পানি সংকটের নিষ্ঠুরতা থেকে ‘অগণিত জীবন বাঁচানোর’ অঙ্গীকার করেছেন।
ইরানের পানির পরিসংখ্যানকে ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে তুলে ধরে তিনি ৫ কোটি বাস্তুচ্যুত প্রাণের বিষয়ে সতর্ক করেছেন এবং একটি ঘোষিত শত্রুর জন্য ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ‘সমাধান’ তুলে ধরেছেন। তার কথাগুলি যখন বায়ুপ্রবাহে ঘুরছে তখন বিষয়টি না বললেই না। মাত্র সত্তর কিলোমিটার দূরে গাজার শিশুরা তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছে। তাদের পানি যে রাষ্ট্রটি বন্ধ করে দিয়েছে সেই তারাই অপরিচিতদের পানি সংকট থেকে উদ্ধার করার দাবি করে।
নেতানিয়াহুর তেহরানের পানি সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব যখন ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়েছে তখন গাজার শিশুরা লবণাক্ত, ব্যাকটেরিয়া সম্বলিত দূষিত পানি পান করছে। অথচ তারাও তো পান করার জন্য এক ফোঁটা পানিও পেতে পারত। অবরুদ্ধ উপত্যকার এলাকাগুলি মাসের পর মাস ধরে পরিষ্কার প্রবাহিত পানি ছাড়াই চলছে। বোমা বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে ধ্বংসস্তূপের নিচে পাইপলাইনগুলি চাপা পড়ে আছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইউনিসেফ এবং ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, অবরোধ-সম্পর্কিত অনাহারের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের সাথে পানির ঘাটতিতে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে অন্তত ৩১৫ জন নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী।
প্রকৃতপক্ষে, এই অমানবিকতা দুর্ঘটনাক্রমে নয় বরং নীতিগত কারণে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট দুই দিন পরে গাজার পূর্ণ অবরোধের রূপরেখা দেন এবং একই রকম তথ্য প্রদান করেন: ‘বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, জ্বালানি নেই, সবকিছু বন্ধ।’ ইসরায়েলি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় পানি সংস্থা মেকোরোট বন্ধ করে দেন, যা প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে আসছিল। এর ফলে আমাদের গ্রহের সবচেয়ে জনবহুল ভূমিগুলির মধ্যে একটিতে মানবসৃষ্ট খরা দেখা দেয়।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় দপ্তরের (ওসিএইচএ) মতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গাজায় প্রতিদিন পাওয়া পানির গড় পরিমাণ মাথাপিছু তিন লিটারেরও কমে নেমে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মতে, একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সর্বনিম্ন যতটুকু পানি প্রয়োজন তার তুলনায় এটি এক পঞ্চমাংশ। ২০২৪ সালের মার্চ নাগাদ উত্তর গাজার বাসিন্দারা প্রতিদিন এক লিটারেরও কম পানি পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি পান করার অযোগ্য হয়ে পড়ে। ৬৫টি পানির কূপ বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে, তিনটি প্রধান ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট এবং ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি পানির পাইপলাইন ধ্বংস করা হয়েছে; জ্বালানি সংকটের কারণে পাম্পিং স্টেশনগুলি অকেজো হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে এটি একটি স্পষ্ট অপরাধ। জেনেভা কনভেনশনের অতিরিক্ত প্রোটোকল-১ এর ৫৪ অনুচ্ছেদে ‘বেসামরিক জনগণের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আক্রমণ, ধ্বংস, অপসারণ বা রূপান্তর’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে যার মধ্যে স্পষ্টভাবে পানির অবকাঠামোকে বিবেচনা করতে হবে। রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি পানির অস্বীকৃতিকে একটি যুদ্ধাপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে যদি এটি বেসামরিক লোকদের অনাহারে রাখার বা তাদের স্থানচ্যুত করার উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘হতাশ, অনাহার এবং অবরুদ্ধ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উপসংহারে বলা হয়, ইসরায়েল পানি এবং খাদ্যের বঞ্চনাকে যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত করেছে কারণ অবরোধের ফলে মহামারীজনিত রোগের মাত্রা বেড়ে চলেছে যা শিশু এবং বয়স্কদের অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে হত্যা করছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল, ইউনিসেফ, এটিকে গাজার শিশুদের জন্য আসন্ন মৃত্যুদণ্ড হিসাবে অভিহিত করেছে।
ইউনিসেফের ২০২৫ সালের মার্চ মাসের মূল্যায়নে যুদ্ধ-পূর্ববর্তী স্তরের তুলনায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়াজনিত রোগ ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অবরোধের প্রথম বছরে পানিশূন্যতা এবং পানিবাহিত রোগের কারণে শিশুমৃত্যুর অন্তত ১২০টি ঘটনা রেকর্ড করেছে।
খান ইউনিসের ছয় বছর বয়সী শিশু মরিয়মের গল্পটি হৃদয়বিদারক। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বোতলজাত পানির অভাবে ছাদের ট্যাঙ্কে সংগৃহীত দূষিত পানি পান করে মারা যায় সে। খান ইউনিস এবং এর আশেপাশের এলাকাগুলিতে পানি সংকটের কারণে শিশুদের জীবনে এক দুঃখজনক পরিস্থিতি নেমে এসেছে। তার মা আল জাজিরাকে বর্ণনা করেছেন: সে সারা রাত পেট ব্যথায় কেঁদেছিলেন। পরের দিন সকাল নাগাদ সে চিরতরে বিদায় নিয়েছে।’’
বেইত লাহিয়ার সত্তর বছর বয়সী হাসান চারটি ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু অবশেষে জীবাণুমুক্ত পানির অভাবে ডায়ালাইসিস মেশিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কিডনি বিকল হয়ে তিনি মারা যান। কামাল আদওয়ান হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গাজা উপত্যকার উত্তরে পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে ৭০ শতাংশ ডায়ালাইসিস সেশন বাতিল করা হয়েছে।
এটিই প্রথমবার নয় যে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৪ সালের অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ-এর সময় ইসরায়েলি হামলায় গাজার বৃহত্তম বর্জ্য পানি শোধনাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কাঁচা পয়ঃনিষ্কাশন পানির পাইপলাইনে প্রবাহিত হয়। ২০২১ সালে, ইইউ-এর অর্থায়নে পরিচালিত ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টগুলিতে বোমা হামলা চালানো হয়। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুনর্গঠন আটকে থাকে, কারিগরি অসুবিধার কারণে নয়, বরং ইসরায়েলের প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে। গাজা পানি কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত সতর্ক করে দিয়েছে, যুদ্ধের পরেও সম্পূর্ণ পূনর্গঠনে বছরের পর বছর সময় লাগবে, যতক্ষণ না অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। জ্বালানি, খুচরা যন্ত্রাংশ এবং পরিশোধনের জন্য রাসায়নিক পণ্য না থাকলে পুনর্বাসনের কথা বলাও অর্থহীন হয়ে পড়ে।
ইরানিদের প্রতি নেতানিয়াহুর বার্তাটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখানে ভণ্ডামি স্পষ্ট: তেল আবিব থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গাজা ইচ্ছাকৃতভাবে পানি-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত, যে প্রযুক্তি ইসরায়েল আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করে। ইসরায়েলের হাতে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের মৃত্যুর বিষয়েও একই কথা বলা যেতে পারে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাঘচি উল্লেখ করেছেন: “এ ধরনের ঘটনা শক্তির ইঙ্গিত দেয় না, বরং বিশ্বব্যাপী সংহতি হারানোর ঘৃণ্য শাসনব্যবস্থার পতনের ইঙ্গিত দেয়।” নেতানিয়াহু নিজেকে ইরানের সম্ভাব্য ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করে এবং বিশ্ব মঞ্চে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে ইরানের ঐক্যকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন, যে ঐক্য ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা।
গ্লোবাল সাউথ এই নীতিকে বর্ণনা করেছে। পাকিস্তান অবরোধকে অবরোধের কৌশল দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধাপরাধ হিসাবে সমালোচনা করেছে। চীন এবং রাশিয়া জাতিসংঘকে পানি অবকাঠামোর ইচ্ছাকৃত লক্ষ্যবস্তুতে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে, এই ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করে। তাদের এই দাবি এমন সংঘাতের মধ্যে এসেছে যেখানে গাজার গুরুত্বপূর্ণ পানি সুবিধাগুলিতে আক্রমণ সরাসরি বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি করেছে।
ইরান বিমান হামলাকে একটি জনগণের উপর পরিবেশগত যুদ্ধ হিসাবে উল্লেখ করেছে। বিপরীতে, ওয়াশিংটন এবং ইউরোপীয় রাজধানীগুলি ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে। গাজায় ইউটিলিটি পুনরুদ্ধারের জন্য নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক জারি করা সমস্ত প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। ফিলিস্তিনি পানি প্রকল্পের জন্য তহবিল সরবরাহকারী দেশগুলি বেশিরভাগ ইউরোপীয়রা, এই প্রকল্প ধ্বংসের জন্য ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে শাস্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবুও তারা নীরব সংলাপে লিপ্ত হয় যা কোনও পার্থক্য করে না।
প্রায় ৯০ শতাংশ বর্জ্য পানি ইসরায়েলে পুনঃব্যবহার করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ হার। দেশটি ড্রিপ সেচ আবিষ্কার করেছে এবং এটিকে বাণিজ্যিক করে তুলেছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের ত্রাণকর্তা হিসেবে নেতানিয়াহু এই পরিসংখ্যানগুলি ব্যবহার করেছেন। তবুও, বেইত হানুনে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি প্রকৌশলীদের একজন যেমন বলেছেন, ‘‘তারা মরুভূমিকে সজীব করে তোলে এমন জাতি হিসেবে স্মরণীয় হতে চায় কিন্তু তারা আমাদের বাড়িকে মরুভূমিতে রূপান্তরিত করেছে।’’
প্রপাগান্ডা বর্ণনাকে রূপায়িত করতে পারে, কিন্তু গাজা থেকে উঠে আসা চিত্রগুলি নেতানিয়াহুর বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে টিকে থাকবে। যে চিত্রে উঠে এসেছে খালি জেরিক্যান ধরে থাকা শিশুরা, লোনা পানি ফুটানো মায়েরা এবং জীবাণুমুক্ত সরঞ্জামের অভাবে বন্ধ করে দেওয়া হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলির দৃশ্য।
গাজা অবরোধ সাম্প্রতিক সময়ে মানবিক সংকটের সেরা নথিভুক্ত উদাহরণ। জাতিসংঘের কেবল, স্যাটেলাইট ছবি এবং হাসপাতালের মৃত্যু শংসাপত্রের আকারে এর প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসের বইয়ে এটা পড়া যাবে না যে, নেতানিয়াহুর এই প্রস্তাব খ্রিস্টান চেতনায় এসেছে, বরং ইতিহাসে এটি ভণ্ডদের জঘন্য প্রতিনিধিত্ব হিসেবে লেখা থাকবে। একজন ব্যক্তি বিদেশীদের পানি দিতে হাত বাড়িয়ে দেন এবং প্রতিবেশীদের গলায় দাঁড়িয়ে তাদের পানি পান করতে বাধা দেন। আর যখন বিশ্ব তার স্তোত্র শুনবে, তখন তাদের গাজার শিশুদের অচিহ্নিত কবরের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যারা শুকনো ঠোঁট নিয়ে মারা গিয়েছিল। সূত্র: তেহরান টাইমস