তিব্বতের মালভূমিতে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে চীন, যা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্মিত হলে এটি হতে পারে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যা চীনের বর্তমান থ্রি গর্জেস ড্যামের চেয়েও তিনগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে। তবে এই ‘সুপার ড্যাম’ ভাটির দেশগুলোর জন্য আশীর্বাদের চেয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে কি না, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ইয়ারলুং সাংপো নদীটি চীনের তিব্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে ‘সিয়াং’ এবং আসামে ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে প্রবেশ করে। এরপর এটি বাংলাদেশে ‘যমুনা’ নামে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই অভিন্ন নদীর ওপর চীনের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে ভারত ও বাংলাদেশের ওপর তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারতের প্রধান উদ্বেগগুলো হলো:
বর্ষায় আকস্মিক বন্যা: বর্ষা মৌসুমে চীন যদি বাঁধ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দেয়, তবে অরুণাচল ও আসামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে।
শুকনো মৌসুমে খরা: অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে চীন পানি আটকে রাখলে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাবে, যা কৃষি, নৌচলাচল এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
যেহেতু বাংলাদেশ এই নদীর ভাটির শেষ দেশ, তাই ভারতের ওপর পড়া যেকোনো প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। পানির প্রবাহ কমে গেলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া আরও তীব্র হতে পারে এবং বর্ষায় বন্যার ঝুঁকিও বাড়বে।
উদ্বেগের বিপরীতে, চীনের হোহাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং পানি মন্ত্রণালয়ের একটি যৌথ গবেষণা ভিন্ন একটি চিত্র তুলে ধরেছে। তাদের মতে, এই ধরনের বাঁধ নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ভূমিকাও রাখতে পারে। ২০১৪ সাল থেকে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর নির্মিত দুটি বাঁধ (জ্যাংমু ও জিয়াচা) থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন:
শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির প্রবাহ প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ সংরক্ষিত পানি ছাড়া হয়েছে।
বর্ষা মৌসুমে বাঁধগুলো অতিরিক্ত পানি ধরে রাখায় ভাটিতে বন্যার চাপ কিছুটা কমেছে।
এই গবেষণা অনুযায়ী, বাঁধগুলো নদীর পানিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা বাড়াতে এবং বর্ষায় বন্যার প্রকোপ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
তবে চীনের গবেষকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে, বিষয়টি এত সরল নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে।
গলিত হিমবাহ: উষ্ণতা বাড়ার কারণে হিমবাহ আগের চেয়ে দ্রুত গলছে, যা নদীর পানির পরিমাণে অস্থায়ী বৃদ্ধি ঘটালেও দীর্ঘমেয়াদে পানির উৎসকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
পানির তাপমাত্রা পরিবর্তন: নদীর পানির তাপমাত্রা বাড়ছে। শীতকালে পানি আগের চেয়ে ঠান্ডা এবং গ্রীষ্মে বেশি উষ্ণ থাকছে, যা মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর প্রজনন ও জীবনচক্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইয়ারলং সাংপো-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা কেবল পরিবেশগতভাবেই নয়, ভূ-রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই নদীর ওপর চীনের যেকোনো পদক্ষেপ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, এই নদীকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র কারিগরি বা অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা না করে পরিবেশগত সুরক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অববাহিকার সব দেশের মধ্যে তথ্য বিনিময়, যৌথ গবেষণা এবং একটি সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি।
ভারত ও বাংলাদেশকে এই প্রকল্পের প্রতিটি ধাপ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ফোরামে নিজেদের উদ্বেগ ও স্বার্থ তুলে ধরতে হবে। টেকসই নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সব দেশের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে এই ‘সুপার ড্যাম’ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট