আধুনিক জীবনযাত্রায় উচ্চ কোলেস্টেরল এবংそれに bağlı হৃদরোগ বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য উদ্বেগ। অনেকেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে চান, কিন্তু ফলের মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক চিনি নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন। পুষ্টিবিদ ও গবেষকরা এই ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করে জানিয়েছেন, পরিমিত পরিমাণে ফল খাওয়া কেবল স্বাস্থ্যকরই নয়, বরং হৃদরোগ প্রতিরোধের অন্যতম সেরা উপায়। আর এই তালিকায় সবচেয়ে কার্যকর ফলগুলোর একটি হলো আপেল।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ১১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন, যা স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় শুধুমাত্র একটি আপেল যোগ করার অভ্যাসই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে অভাবনীয় পরিবর্তন আনতে পারে।
আপেলের মধ্যে থাকা একাধিক জৈব-সক্রিয় উপাদান শরীরকে বিভিন্ন দিক থেকে সুরক্ষা দেয়। এর কার্যকারিতা কেবল একটি উপাদানের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং একাধিক উপাদানের সম্মিলিত প্রভাবের ফল।
১. দ্রবণীয় ফাইবার ‘পেকটিন’-এর ভূমিকা:
আপেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পেকটিন, যা এক ধরনের দ্রবণীয় ফাইবার। আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, পেকটিন হজমতন্ত্রে প্রবেশ করে একটি জেল-সদৃশ পদার্থ তৈরি করে। এই জেলটি খাদ্য থেকে আসা কোলেস্টেরল এবং পিত্তরসের (Bile Acid) সঙ্গে আবদ্ধ হয়। ফলে শরীর এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো শোষণ করতে পারে না এবং মলের সঙ্গে তা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। যেহেতু পিত্তরস তৈরিতে লিভার রক্তের কোলেস্টেরল ব্যবহার করে, তাই শরীর থেকে পিত্তরস বেরিয়ে গেলে লিভার রক্ত থেকে আরও বেশি কোলেস্টেরল টেনে নেয়। এর ফলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে। একটি মাঝারি আকারের আপেলে প্রায় ৪ গ্রাম ফাইবার থাকে, যা আমাদের দৈনিক চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম।
২. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের শক্তি: পলিফেনল:
আপেল, বিশেষ করে এর খোসায়, পলিফেনল নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রচুর পরিমাণে থাকে। আমাদের রক্তে থাকা LDL বা খারাপ কোলেস্টেরল নিজে ততটা ক্ষতিকর নয়, যতটা ক্ষতিকর এর অক্সিডাইজড্ (Oxidized) রূপ। এই অক্সিডেশনের ফলেই LDL কণাগুলো রক্তনালির দেওয়ালে জমে গিয়ে প্লাক (Plaque) তৈরি করে, যা রক্ত চলাচলে বাধা দেয় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আপেলের পলিফেনল এই অক্সিডেশন প্রক্রিয়াকে বাধা দিয়ে রক্তনালিকে সুস্থ ও নমনীয় রাখতে সাহায্য করে।
৩. অন্ত্রের স্বাস্থ্য ও কোলেস্টেরল:
আপেলে থাকা পেকটিন একটি চমৎকার প্রিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। এটি আমাদের অন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য জোগায় এবং তাদের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এই উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো ফাইবারকে গাঁজন (Fermentation) করে শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড (Short-Chain Fatty Acids - SCFAs) তৈরি করে। এই SCFAs লিভারে কোলেস্টেরল তৈরির প্রক্রিয়াকে দমন করতে সাহায্য করে, যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়ক।
৪. ফাইটোস্টেরলের কার্যকারিতা:
আপেলে ফাইটোস্টেরল নামক উদ্ভিজ্জ যৌগ থাকে, যার গঠন অনেকটা কোলেস্টেরলের মতো। এই যৌগগুলো আমাদের হজমতন্ত্রে কোলেস্টেরল শোষণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা কোলেস্টেরলের একটি বড় অংশ শরীরে শোষিত না হয়ে বেরিয়ে যায়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে রক্তে মোট কোলেস্টেরল এবং LDL কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস পায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আপেল একটি শক্তিশালী অস্ত্র হলেও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সামগ্রিক স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অপরিহার্য।
ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস: ওটস, বার্লি, বিনস, ডাল, বিভিন্ন শাক-সবজি, বাদাম এবং অন্যান্য ফল খাদ্যতালিকায় যোগ করুন।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট গ্রহণ: ট্রান্স ফ্যাট ও পরিশোধিত স্যাচুরেটেড ফ্যাট (যেমন: ভাজাপোড়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার) বর্জন করুন। এর পরিবর্তে অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, বাদাম এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ (যেমন: স্যামন, সার্ডিন) গ্রহণ করুন।
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম: আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর মতে, সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম (যেমন: দ্রুত হাঁটা, জগিং, সাঁতার) ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে সাহায্য করে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ শরীরে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়ায়, যা কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক চাপ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর।
ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন: ধূমপান HDL বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং রক্তনালির মারাত্মক ক্ষতি করে। অতিরিক্ত মদ্যপানও কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়াতে পারে।
আপেল এমন একটি সহজলভ্য ও সুস্বাদু ফল, যা কোলেস্টেরল কমানো এবং হৃদপিণ্ডকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত। এর মধ্যে থাকা দ্রবণীয় ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রাকৃতিক যৌগগুলোর সম্মিলিত প্রভাব একে একটি "হার্ট-হেলদি সুপারফুড" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই আপনার খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন একটি আপেল যোগ করা কেবল অভাবে স্বভাব নষ্ট নয়, এটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ।
সূত্র:
Centers for Disease Control and Prevention (CDC). "High Cholesterol Facts."
Koutsos, A., et al. (2015). "Apples and Cardiovascular Health—Is the Gut Microbiota a Core Consideration?" Nutrients.
American Journal of Clinical Nutrition. "Cholesterol-lowering effects of apple pectin."
Harvard T.H. Chan School of Public Health. "The Nutrition Source - Apples."
American Heart Association (AHA). "Prevention and Treatment of High Cholesterol (Hyperlipidemia)."