উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ ঘটনায় দগ্ধ অর্ধশতাধিক মানুষের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আঙিনা। সন্তান, নাতি, ভাই-বোনের জন্য স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদে চারপাশে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এমন দৃশ্য দেখা যায়। সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৬০ জনকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
আমরা ওকে মানুষ করছি খুব যত্নে, আজ পর্যন্ত কোনো আঘাত লাগতে দেইনি। এখন সে হাসপাতালের বিছানায় দগ্ধ হয়ে পড়ে আছে, কীভাবে সে সহ্য করছে জানি না। বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে বসে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিলেন ঝর্না আক্তার। তার ছোট ছেলে জুনায়েদ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী, এ দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে বসে কাঁদতে কাঁদতে আর একজন মা বলেন, আমার ছেলেটা খুব ভালো ছিল। মাঠে খেলতে গিয়েছিল, এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, মহান আল্লাহ যেন আমার ছেলেসহ সবাইকে সুস্থ করে দেন।
নিহতদের মধ্যে নাহিদ হাসান নামের একজন রয়েছে। নিজের নাতনিকে হারিয়ে আহাজারি করছেন মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমার প্রিয় নাতনি নাহিদ হাসান উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ত। বাসা থেকে হেঁটে আসতে ৫/৭ মিনিট লাগে। আমার কলিজার টুকরা নাই। না করছি, বড় স্কুল কলেজে পড়াইস না। আজরাইলে নিছেরে, আমার কলিজারে আজরাইলে নিছে। সোমবার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে রাস্তায় বসে এভাবেই আহাজারি করেন মোসলেম উদ্দিন।
এদিকে, বার্ন ইনস্টিটিউটে অবস্থানরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ দগ্ধ শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের চিকিৎসা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে স্বজনদের মানসিকভাবে শক্ত রাখতেও সহায়তা করছে হাসপাতালের কাউন্সেলিং টিম। সোমবার দুপুরে উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজেআই মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। একইভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসলিম উদ্দিন, যিনি তার একমাত্র নাতিকে নিয়ে এসেছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার নাতিও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে এবং বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন, আপনারা দোয়া করেন, আমার নাতি যেনো বাঁচে। একমাত্র নাতি আমার, কী কষ্টে আছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইম খান এসেছেন তার ছোট বোনকে নিয়ে। তার বোন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি। সাইম বলেন, আমার বোনসহ যারা আহত হয়েছে, সবার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। কেউ যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাইলস্টোন কলেজের মূল ক্যাম্পাসের উত্তর পাশে খেলার মাঠ ঘেঁষা অংশেই বিমানটি পড়ে। পাশেই অবস্থিত প্রাইমারি শাখার ভবন। দুর্ঘটনার পরপরই ছুটে আসেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা। অনেক মা-বাবাকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সন্তানদের নাম ধরে ডেকে কাঁদতে দেখা যায়। নাবিলা নামের কলেজ শাখার এক শিক্ষার্থী বলেন, বিকট শব্দ হতেই ক্লাসের শিশুরা ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী হয়েছে? জানালার পাশে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। কিছু শিক্ষার্থী দৌড়ে নিচে নেমে যায়। বাচ্চারা ভেতরেই ছিল। কেউ বের হতে পারেনি। ফারজানা হক নামের এক অভিভাবক বলেন, হঠাৎ একটা বড় আওয়াজ হলো। তাকিয়ে দেখি ধোঁয়া উঠছে। স্কুলের পাশেই আগুন আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। শিশুদের কাঁদতে দেখেছি। এর আগে দুপুর ১টার পর রাজধানীর উত্তরায় দুর্ঘটনায় পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। বিমানটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও স্কুল ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। যে ভবনে এটি বিধ্বস্ত হয় সেখানে বহু স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা গেছে। যাদের বেশিরভাগই হতাহত হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপর উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। উত্তরাসহ আশপাশের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং হতাহতদের উদ্ধার করা শুরু করে। পরে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয় বিজিবি ও সেনাবাহিনী। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে হতাহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়।
বার্ন ইনস্টিটিউটে রক্তের জন্য মাইকিং: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত ৬০ জনের অধিক মানুষকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে রক্তের জন্য ইনস্টিটিউটের ভেতরে এবং বাইরে মাইকিং করা হচ্ছে।
সোমবার বিকালে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা যায়, দলে দলে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রক্ত দিতে আসছেন। তবে পজিটিভ রক্ত পর্যাপ্ত হয়ে গেলেও সংকট রয়েছে নেগেটিভ রক্তের। এ অবস্থায় মেডিক্যালের ভেতরে এবং বাইরে মাইকিং করা হচ্ছে রক্তের জন্য। পাশাপাশি মেডিক্যালের বাইরে ট্রাফিক পুলিশ সদস্য সাঈদও তার হ্যান্ড-মাইক দিয়ে নেগেটিভ রক্তের জন্য মাইকিং করছেন। সংকট এখনও আছে বলে তিনি জানান। আহতদের জন্য রক্ত সংগ্রহের কাজে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। দুর্ঘটনার স্থানের পাশেই তারা মাইকিং করে রক্ত দেওয়ার আহŸান জানাচ্ছেন।
এ সময় রক্তদাতার নাম ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করছিলেন উত্তরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সুমাইয়া কবির মীম। তিনি বলেন, শতাধিক মানুষ এখন পর্যন্ত রক্ত দিতে তাদের নাম যুক্ত করেছেন। যারা রক্ত দিতে আগ্রহী, আমরা তাদের নাম-ফোন নম্বর রেখে দিচ্ছি। যখন দরকার হচ্ছে আমরা এম্বুলেন্সে পাঠিয়ে দিচ্ছি নির্দিষ্ট হাসপাতালে। এখন পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি মানুষকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে রক্ত দেওয়ার জন্য।
তিনি আরও বলেন, যারা রক্ত দিতে চান, আমরা তাদের এম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
একটি মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলের রাধুনি হিসেবে কাজ করেন হনুফা আক্তার। তিনিও এসেছেন রক্ত দিতে। হনুফা বলেন, এখানে ছেলেরা রক্তের প্রয়োজন জানিয়ে মাইকিং করছে। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। আমার ছেলে-মেয়েদের জন্য রক্ত দরকার। এটা আমার আয়ত্বের মধ্যে আছে, এটাতো আমি করতে পারি।
আরেক রক্তদাতা আরিফুল ইসলাম বলেন, এখানে এসেছিলাম ঘটনা দেখতে। তখন শুনলাম, যারা আহত হয়েছেন তাদের নাকি রক্ত দরকার। তাই রক্ত দেওয়ার জন্য নাম দিলাম। যদি তাদের জন্য এতটুকু করতে পারি তাহলে নিজের কাছে ভালো লাগবে। সূত্র: ইনকিলাব