কুয়েত তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং চাঞ্চল্যকর নাগরিকত্ব জালিয়াতির ঘটনা উন্মোচন করেছে। একটি দীর্ঘ ও জটিল তদন্তের পর দেশটির সরকার ১,০৬০ জনেরও বেশি ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। কুয়েতের সুপ্রিম কমিটি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতীয়তা তদন্ত বিভাগের যৌথ অভিযানে এই বিশাল জালিয়াত চক্রের সন্ধান মেলে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, বহু বছর ধরে অসংখ্য ব্যক্তি মিথ্যা পরিচয়, জাল কাগজপত্র এবং অবৈধভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করে কুয়েতের নাগরিক হিসেবে বসবাস করছিলেন, যা দেশটির নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছিল।
তদন্তের প্রেক্ষাপট ও পদ্ধতি:
স্থানীয় পত্রিকা 'আল রাই'-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই জালিয়াতির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। কুয়েতি কর্তৃপক্ষ গত বছর একটি গোপন সূত্রের ভিত্তিতে ২০০৮ সালের একটি পুরোনো মামলা পুনরায় চালু করার মাধ্যমে এই তদন্তের গতি বাড়ায়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই তদন্তে জালিয়াতদের চিহ্নিত করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল:
ডিএনএ পরীক্ষা: পারিবারিক সম্পর্ক যাচাই করার জন্য ব্যাপকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা চালানো হয়।
নথিপত্র যাচাই: জন্মনিবন্ধন, পারিবারিক সনদ এবং অন্যান্য সরকারি নথি কঠোরভাবে পরীক্ষা করা হয়।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: দ্বৈত নাগরিকত্বের তথ্য নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উপসাগরীয় ও আরব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।
চাঞ্চল্যকর দুটি ঘটনা:
১. এক ব্যক্তির নামে ১৬৬ জনের জাল নাগরিকত্ব:
তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণকারী এক ব্যক্তির মামলা। ওই ব্যক্তি মূলত অন্য একটি উপসাগরীয় দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কুয়েতি নাগরিকত্ব ধারণ করেছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি তার অপরাধ স্বীকার করলেও অজ্ঞাত কারণে সরকারি নথি থেকে তার নাম বাদ যায়নি। এই সুযোগে তিনি তার নামে ৪৪ জন সন্তান এবং ১২২ জন নির্ভরশীল ব্যক্তি (মোট ১৬৬ জন) যুক্ত করেন। পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণ হয় যে, এই বিপুল সংখ্যক মানুষের অনেকের সঙ্গেই তার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তারা কেবল তার নামের ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে কুয়েতি নাগরিকত্ব ভোগ করছিল।
২. মৃত ব্যক্তির নামে ৪৪০ জনের নাগরিকত্ব:
আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনায়, ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া এক মৃত ব্যক্তির নামে ৪৪০ জন ব্যক্তি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিল। তদন্ত কমিটি তাদের সর্বশেষ বৈঠকে এই ৪৪০ জনের সকলের নাগরিকত্ব একযোগে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। কীভাবে একজন মৃত ব্যক্তির পরিচয় ব্যবহার করে এত বড় একটি জালিয়াতি সম্ভব হলো, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ আরও গভীর তদন্ত চালাচ্ছে।
সাম্প্রতিক অভিযান ও দ্বৈত নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান:
সর্বশেষ অভিযানে চারটি বড় মামলার আওতায় প্রায় ৭০০ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ জন ব্যক্তি কুয়েতি নাগরিকত্বের পাশাপাশি অন্য উপসাগরীয় বা আরব দেশের নাগরিকত্বও ধারণ করেছিলেন। কুয়েতের আইন অনুযায়ী, দ্বৈত নাগরিকত্ব সম্পূর্ণ অবৈধ। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার দ্বৈত নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থান পুনরায় স্পষ্ট করেছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিটি নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্তই সুনির্দিষ্ট এবং অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে। এই অভিযান কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের নাগরিকত্ব আইনের পবিত্রতা রক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত রাখার একটি প্রয়াস। ভবিষ্যতেও এই ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়েছে। সূত্র: গালফ নিউজ