কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়ালের ভেতর থেকেই নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বাধ্য হচ্ছেন তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বিক্রি করতে—কোটি টাকার শেয়ার ও গুলশানের অভিজাত এলাকার জমি—যাতে বকেয়া বেতন পরিশোধ ও প্রায় ৮,৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা যায়।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয়, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নামে থাকা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির ৪৩ কোটি ৫ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। আরও অর্থের জন্য রাজধানীর গুলশানের (৭০ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর প্লট) নজরুল ইসলামের নামে থাকা ৪০ শতক জমি বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নাসা গ্রুপে নিয়োগ করা প্রশাসক আরিফ আহমেদ খান, গত ১৯ অক্টোবর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এক চিঠিতে শেয়ার বিক্রি করে শ্রমিকের আগস্ট মাসের বেতন দেওয়ার তথ্য জানিয়েছেন। টিবিএস ওই চিঠি দেখেছে। এতে তিনি নিশ্চিত করেন যে, নাসা গ্রুপের বিভিন্ন কারখানার ১৭ হাজার ১৩৪ জন শ্রমিকের গত আগষ্ট মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে তাদের ডাচ-বাংলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। প্রায় ১,২০০ শ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে ত্রুটি থাকায় ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ত্রুটি দূর করে দ্রুত তাদের বেতন পরিশোধের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
নাসা গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, গুলশানের সম্পত্তিটি বিক্রি করে প্রায় ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে—যা ঋণ পুনঃতফসিল ও বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণে ব্যয় হবে।
টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প কারখানা নিয়ে গঠিত একসময়ের সফল পোশাক রপ্তানিকারক এই গ্রুপটি গত বছরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকেই দুর্নীতির মামলায় চেয়ারম্যান কারাগারে থাকায় কারখানা বন্ধ ও বেতন অনিয়মে পড়েছে।
নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার আগের সরকারের সময়ে রাজনৈতিক আনুকূল্যে ছিলেন, তখন নাসার পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলোও পূর্ণোদ্যমে চালু ছিল। কিন্তু গত বছরের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই গ্রুপটি টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। জুলাই থেকে বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, আর চালু প্রতিষ্ঠানেও অনিয়মিত বেতন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
আদালতের অনুমোদন নিয়ে শেয়ার বিক্রি
বেতন পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করে নাসা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ সাইফুল আলম টিবিএস-কে বলেন, শ্রমিকদের আগষ্টের বেতন পুরো পরিশোধ করা হয়েছে। এই মুহুর্তে চালু রয়েছে এমন ৯টি কারখানার শ্রমিকদের সেপ্টেম্বরের বেতনও পরিশোধ করা হয়েছে। আর যেসব কারখানা চালু নেই, সেখানকার শ্রমিকদের সেপ্টেম্বরের বেতন আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এজন্য চেয়ারম্যানের শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে।
নাসা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন যে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিজের নামে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনা রয়েছে। এইসব শেয়ারের লেনদেন ফ্রিজ করে রেখেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার জন্য আদালতের মাধ্যমে এই শেয়ার বিক্রির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। আদালত শুধুমাত্র শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য এসব শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নামে যেসব শেয়ার রয়েছে বর্তমানে তার বাজারমূল্য ৮৬ কোটি টাকা। পুরো শেয়ারই বিক্রি করা হবে। দুদক যখন এসব শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন এর বাজারমূল্য ছিল ৩০০ কোটি টাকা।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ৪৩.৫৮ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। বাকি প্রায় ৪৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি প্রক্রিয়াধীন। এই টাকা দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের বেতন পরিশোধ করা হবে।
ঋণ সংকট আরও ঘনীভূত
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল শিল্পগোষ্ঠী নাসা গ্রুপ জুলাই থেকে নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না, কারণ ২২টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ৮ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর থেকেই বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা একাধিকবার আন্দোলন করেছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নাসা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে। ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে নাসা গ্রুপের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে অনুযায়ী, ঋণ পুনঃতফসিল করতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লাগবে। এই অর্থ ছাড়া আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলা এবং ব্যবসা পুনরায় চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
নাসার ২৫টি কারখানার মধ্যে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ৯টি চালু রেখে বাকি ১৬টি বন্ধের পরিকল্পনা করছে। এসব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে ১৫৪ কোটি টাকার সার্ভিস বেনিফিট দিতে হবে। সব মিলিয়ে গ্রুপটির তাৎক্ষণিক স্থিতিশীলতার জন্য কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার প্রয়োজন।
কারাফটকের বৈঠকে সম্পত্তি বিক্রির অনুমোদন
নাসা গ্রুপের শ্রম অসন্তোষ নিরসনের জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে ত্রি-পক্ষীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয় নাসা গ্রুপের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের আগষ্ট মাসের বেতন ১৫ অক্টোবরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
এজন্য নাসা গ্রুপের মালিকের সম্পদ বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসাপেক্ষে গত ১৭ আগষ্ট জেল গেটে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের সাথে নাসা গ্রুপ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংক এবং সরকারি একাধিক সংস্থার প্রতিনিধিদের এক মিটিং হয়। ওই বৈঠকে নজরুল ইসলাম মজুমদার তার স্থায়ী ও অস্থায়ী কিছু সম্পদ বিক্রির অনুমোদন ক্ষমতা দেন (পাওয়ার অব এটর্নি/ আমমোক্তারনামা), যেগুলো কোথাও জামানত হিসেবে দেওয়া নেই। সে অনুযায়ী, শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে।
নাসা গ্রুপের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু; অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের থেকে অর্ডার নেওয়ার অগ্রগতি জানতে চাইলে গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ সাইফুল আলম বলেন, "এলসি খোলা এখনও শুরু হয়নি। ব্যাংকগুলোর সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। ব্যাংকের পেমেন্ট করার প্রস্তুতি চলছে। আশা করছি, নভেম্বরের মধ্যে এসব প্রক্রিয়া শেষ করে এলসি খোলা শুরু হবে।"
১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় প্রায় ১৭ বছর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানও ছিলেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর— ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী নাসরিন ইসলামকে এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ থেকে অপসারণ করে।
২৫ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নজরুল ও তার স্ত্রীর সব ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ দেয়।
গতবছরের ২ অক্টোবর নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়, এরপর রপ্তানির নামে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা (প্রায় ৩০ লাখ ডলার) যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের অভিযোগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে।
সিআইডির প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, তিনি নাসা গ্রুপের ফিরোজা গার্মেন্টসের মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের এ অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা