ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় আওয়ামী লীগ নেতার বাসা থেকে ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার চুরির গল্প ফেঁদে কোটি টাকার প্রতারণার জাল বিছিয়েছে এক ভয়ঙ্কর চক্র। কম দামে ডলার বিক্রির লোভ দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজনকে ডেকে এনে দুর্গম এলাকায় নিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়াই তাদের কাজ। সম্প্রতি এটিএন নিউজের এক সাহসী অনুসন্ধানে এই প্রতারক চক্রের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে। ক্রেতা সেজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই চক্রের আস্তানা পর্যন্ত পৌঁছে যায় এটিএন নিউজ টিম।
ঘটনার সূত্রপাত:
ঘটনার শুরু হয় এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ দিয়ে। পলাতক এক আওয়ামী লীগ নেতার বাসা থেকে তার গৃহকর্মী শাহানাজ পারভীন ৭৫ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় কোটি টাকা) লুট করেছেন বলে প্রচার করা হয়। এরপর তার ছেলে মোহাম্মদ শাকিল ও চাচাতো ভাই মোহাম্মদ রুবেল প্রায় এক বছর ধরে সেই ডলার বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজতে থাকে।
এটিএন নিউজের অনুসন্ধান:
এই খবরের সত্যতা যাচাই করতে এবং চক্রটিকে ধরতে এটিএন নিউজ টিম ক্রেতা সেজে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। চক্রের সদস্য রুবেলের সাথে ফোনে কথা হয় এবং সে ডলার চুরির ঘটনাকে সত্য বলে দাবি করে। প্রথম দফায়, এটিএন নিউজ টিম ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় পৌঁছায়। সেখানে শাকিল ও রুবেল একটি অটোরিকশায় করে এসে কিছু ডলার নমুনা হিসেবে দেখায় এবং বাকি আলোচনার জন্য পরে যোগাযোগ করবে বলে স্থান ত্যাগ করে।
দুই দিন পর, এটিএন নিউজ টিম আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে ডলার কেনার আগ্রহ দেখিয়ে পুনরায় তাদের সাথে যোগাযোগ করে। এবার শাকিল শর্ত দেয়, নগদ টাকা নিয়ে তাদের গোপন আস্তানায় যেতে হবে।
ভয়ঙ্কর চক্রের স্বরূপ উন্মোচন:
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এটি একটি ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র। ডলার বিক্রির নামে তারা মানুষকে নির্জন স্থানে নিয়ে আটকে রেখে মারধর করে এবং টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়। এমনকি এই চক্রের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানান স্থানীয়রা।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে এটিএন নিউজ টিম ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কাগজের বান্ডিলের উপরে ও নিচে আসল টাকা দিয়ে আড়াই লাখ টাকার একটি নকল বান্ডিল তৈরি করা হয়। পরদিন সকালে রুবেল একটি অটোরিকশা নিয়ে আসে এবং প্রতিবেদককে নিয়ে তাদের গোপন আস্তানার দিকে রওনা দেয়। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে দুর্গম ও জনশূন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় চালক দ্রুতগতিতে রিকশা চালাতে থাকে, যা সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়।
প্রতারক চক্রের আস্তানায় হানা:
চরম বিপদ বুঝতে পেরে প্রতিবেদক কৌশলে রিকশা থেকে নেমে পড়েন। এরপর স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় প্রায় দুই ঘণ্টা অনুসন্ধান চালিয়ে প্রথমে অটোরিকশা চালককে এবং পরে প্রতারক চক্রের সদস্যদের খুঁজে বের করা হয়।
এটিএন নিউজ টিম ও স্থানীয়রা মিলে চক্রের মূল হোতা শাকিল ও রুবেলের বাড়িতে হানা দেয়। তখন তারা পালিয়ে গেলেও শাকিলের মা শাহানাজ পারভীনকে বাড়িতে পাওয়া যায়। প্রথমে তিনি ডলার চুরির ঘটনা অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করেন যে, তার ছেলে প্রতারণার সাথে জড়িত এবং ডলার বিক্রির গল্পটি সাজানো। তিনি আরও জানান, এই চক্র মানুষকে ডেকে এনে মারধর করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়।
পরে স্থানীয় জনতা রুবেল ও শাকিলের তালাবদ্ধ ঘরে ঢুকে নির্যাতনের কাজে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্র, যেমন ধারালো দা, উদ্ধার করে। জানা যায়, চক্রের মূল হোতা আজগর এই প্রতারণার মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় একটি দোতলা পাকা বাড়িও তৈরি করেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু অসাধু পুলিশ ও রাজনৈতিক ব্যক্তির ছত্রছায়ায় এই চক্রটি বছরের পর বছর ধরে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এটিএন নিউজের এই বিশেষ অনুসন্ধানে এক ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্রের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, যা বহু মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়ার কারণ। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য দ্বিতীয় পর্বে তুলে ধরা হবে।