এম আর আমিন, চট্টগ্রাম: দীর্ঘদিন ধরে রেলের সরবরাহ ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে আসছিলেন রেল মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব ফজলে করিম চৌধুরীর ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী তবে সম্প্রতি রেলের সিসিএস দপ্তর তাঁর প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমে ফিরেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের যন্ত্রাংশ ক্রয়ে প্রভাব বিস্তার রোধে ইলেক্ট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ইজিপি) সিস্টেম বহাল রেখেছে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের (সিসিএস) দপ্তর। এর ফলে ভেস্তে গেছে প্রভাব বিস্তার করে সাপ্লাই অর্ডার পাওয়ার ক্ষমতা। পক্ষান্তরে সরকারের টাকার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি ডয়েজ ডিজেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশসহ নানা কেনাকাটায় এমনটি হচ্ছে বলে বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দীর্ঘদিন ধরে ফজলে করিমের ছেলের বাইরে কেউ টেন্ডারে টিকতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেল মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব ফজলে করিম চৌধুরীর ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী তার পিতার ক্ষমতার দাপটে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে পাওয়ার কারে ব্যবহৃত ডয়েজ ডিজেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ কেনাকাটায়। এবার এই ইজিপি সিস্টেমে দরপত্র আহবান করায় বিভিন্ন প্রতিযোগীরা টেন্ডারে অংশ নিতে পেরেছে। রেলওয়ের নীতিমালা ও টেন্ডার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার ফলে এখন সেই প্রভাববলয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। রেল খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের বদলে ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতা ফিরছে—যা দীর্ঘদিনের ‘ফজলে করিম অধ্যায়ের’ অবসানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৩ শতাধিক ডিজেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ গতবছর সরবরাহ না করায় স্টকশুন্যে নেমে আসে। সেই সংকট কাটাতে সম্প্রতি ৪টি দরপত্র আহবান করা হয়। যার টেন্ডার আইডি নং- ১০৯৩৮২৬, ১০৯৩৮৮৫, ১০৯৩৭৪৪ এবং ১০৯২১৯৭। দরপত্র খোলার তারিখঃ ২৬ ও ২৭ মে ২০২৫। ইজিপি সিস্টেম থাকায় এই চারটি টেন্ডারে মোট আটটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো অগ্রনী এন্টারপ্রাইজ, আজমাইন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, হামজা এসোসিয়েট, ইননেট বাংলাদেশ, মেসার্স এ এন্ড জে ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স কহিনুর এন্টারপ্রাইজ, নেক্সট জেনারেরেশন গ্রাফিক্স লিমিটেড এবং সেকুরা বাংলাদেশ লিমিটেড। এরমধ্যে ৩টি টেন্ডারে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কেটি ৭৩ লাখ ৯৫ হাজার ৮১৬ টাকা, সামান্য লেজ দিয়ে সাবমিট করায় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে আজমাইন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। আর ১০৯২১৯৭ নং টেন্ডারে ১৭ শতাংশ এভাব হওয়ায় এটি বাতিল করে রিটেন্ডারের প্রক্রিয়ায় আছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ডিজেল ইঞ্জিনগুলো (পাওয়ার কার) সবসময় রাস্তায় চলে, ফলে এর যন্ত্রাংশ লাগানোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এখানে কোনভাবেই নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা যাবেনা। একটা খুচরা পার্টসের জন্য সহস্রাধিক মানুষ ভোগান্তিতে পড়তে পারে। সবকিছু ভেবে পাওয়াকারে মূল উৎপাদনকারীদের তৈরিকৃত অরিজিনাল যন্ত্রাংশ (ডয়েজ জার্মান) সরবরাহ নিশ্চিত করে।
যেভাবে ধরা হয়েছে দর: রেলওয়ে সূত্র জানায় যেহেতু পাওয়ার কারের যন্ত্রাংশ সম্পূর্ণ বিদেশি এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অরিজিনাল দিতে হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে বাজার যাচাই করার কোন সুযোগ নেই। বা থাকলেও ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার ঝুকি থাকে। ফলে সঠিক মূল্য নির্ধারণের জন্য ডয়েজ জার্মাানিকে (ইঞ্জিন উৎপাদনকারী) দর জানতে চেয়ে চিঠি দেয় রেলওয়ে। সেখান থেকে চিঠি আসে এশিয়া প্যাসিফিক নামের তাদের অনুমোদিত ডিলারের কছে তারা রেলের চাহিত তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত দর জানিয়ে চিঠি দেয় রেলকে। আবার ডয়েজ অনুমোদিত বাংলাদেশের এজেন্ট ফ্যাভ ডিজেল এন্ড সার্ভিস থেকে একটি মূল্য তালিকা সংগ্রহ করে রেল। ২ টির দরের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিকের দর কম থাকায় সেটি গ্রহণ করে তার সাথে ভ্যাট, ট্যাক্স ও সরবরাহকারীর ৫ শতাংশ লাভ হিসেব করে দর প্রাক্কলন করা হয়েছে।
দর বৃদ্ধির বিষয়ে সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে তা রেল কখনোই কমাতে পারে না। আর দাম কমাতে গিয়ে পণ্যের গুনগত মান ঠিক না থাকলে বা রাস্তায় কিছু নষ্ট হলে যাত্রী ভোগান্তি বাড়তে পারে। আর সেই ভোগান্তির দায় রেলের উপরই বর্তায়। সুতরাং পণ্যের কোয়ালিটি ধরে রাখা জরুরী।
রেলের অপর একটি সূত্র জানায়, কতিপয় ঠিকাদার বা রেলের লোক গণমাধ্যমে ভুল তথ্য সরবরাহ করছে, এতে করে কাজের সঠিক পরিবেশ থাকছে না। সম্প্রতি ফজলে করিমের পুত্র ফারাজ করিম তথা আওয়ামী লীগকে পুণর্বাসন করার বিষয় ওঠে আসছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ফারাজ করিম বা ফজলে করিমের কোন প্রতিনিধি কোন টেন্ডারে অংশ নেয়নি। একসময় ফারাজ করিমের প্রভাবে যারা একচেটিয়া ব্যবসা করেছে তারা পূর্বের মতো এখনো সেইভাবে কাজ করতে চাইছে। তা করতে না পেরে কাজের পরিবেশ নষ্ট করছে।
প্রকৃতপক্ষে ফ্যাভ ডিজেল সেলস এন্ড সার্ভিসের মালিক খান মো. আহসান এবং নেক্সট জেনারেশন গ্রাফিক্স লিমিটেড (এনজিজিএল) এর মালিক (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) আহসান খানের পুত্র ভিভেক আহসান খান। এখানে ফজলে করিম বা ফারাজ করিমের কোন মালিকানা নেই।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এই একচেটিয়া নীতিমালাটি ভেঙ্গে দেন প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো. বেলাল হোসেন সরকার। তিনি ডিজি রেলওয়ের অনুমোদন নিয়ে সরাসরি ক্রয় (ডিপিএম) হতে সবার অংশ গ্রহণের সুযোগ রেখে উম্মুক্ত দরপত্র বা ইজিপিতে ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) মো. বেলাল সরকারকে ফোনে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পরিবর্তন রেলের সাপ্লাই চেইনে নিরপেক্ষতা এবং নতুন উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ।