সহযোগীদের খবর: বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ২০২৪ সালে লবণের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ২৬ লাখ ১০ হাজার টন। তবে উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৫১ হাজার ৬৫১ টন। ফলে ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৯ টন। দেশে লবণের চাহিদার অর্ধেক বা প্রায় ১৩ লাখ টন শিল্প খাতে ব্যবহার হয়। কিন্তু তখন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চাহিদা কমে অর্ধেকে নেমে আসে। সূত্র: বণিক বার্তা
এ হিসাবে উৎপাদন ঘাটতি থাকলেও দেশে লবণের মজুদ রয়েছে সাড়ে তিন লাখ টনের বেশি। কিন্তু এক শ্রেণীর মিল মালিকের আগ্রহে উৎপাদন মৌসুমে হঠাৎই এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমোদন নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রেক্ষাপটে লবণের দাম ও চাষের উপযোগী জমির লিজ মূল্য কমতে শুরু করায় সাধারণ লবণ চাষী এবং জমির মালিক উভয়ই বিপাকে পড়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিসিকের লবণ সেলের প্রধান সরোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে উৎপাদন না হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে লবণের ঘাটতি রয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে। এর পরও কোনো ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে লবণ আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে আমদানি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এরই মধ্যে আগামী বছরের চাহিদা নির্ধারণ করে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করায় উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে।’
কক্সবাজারের কৃষক ও মিল মালিকরা বলছেন, দেশে এখনো লবণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করেই আমদানির তোড়জোড় শুরু করে বিসিক। এ খবরে লবণের দাম মণপ্রতি (৪২-৪৪ কেজি) ২০ টাকা পর্যন্ত কমে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম কমে যাওয়া ও আমদানির খবরে মৌসুম শুরুর এক মাস পেরিয়ে গেলেও চাষীরা মাঠে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করেননি। সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৫০০ টন। অথচ ২০২৪ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫ হাজার টন। লোকসানের আশঙ্কায় চাষীরা মাঠে না নামায় এ বছর মৌসুমের শুরুতে লবণ উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে খোদ বিসিক কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ২০২৪ সালে লবণ উৎপাদনের জন্য বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকায় জমি লিজ নিয়েছিলেন চাষীরা। তবে এ বছর দাম কমে যাওয়া ও মৌসুমের শুরুতে আমদানির অনুমতি দেয়ায় লিজ মূল্য কমতে শুরু করেছে। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন ১৫-২০ হাজার টাকায় জমি হস্তান্তর করেছেন মালিকরা। আবার লিজ মূল্য কম থাকায় অনেকে জমি দিচ্ছেন না। এতে আগ্রহ থাকলেও অনেক চাষী মাঠে যেতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে লবণ চাষ ও উৎপাদনসংশ্লিষ্টরা বণিক বার্তাকে জানান, দেশে সংকট থাকলে সরকার লবণ আমদানির অনুমোদন দেয়। ২০২৪ সালে উৎপাদন সাড়ে তিন লাখ টনের মতো কম হলেও শিল্প খাতে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন লবণ ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু সরকারি চাহিদা ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, এখনো সাড়ে তিন লাখ টন ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় লবণ আমদানিতে ব্যবসায়ী বা মিল মালিকদের খুব একটা আগ্রহ নেই। তবে পরবর্তী সময়ে সরকার আমদানিতে নিরুৎসাহিত হতে পারে, এজন্য শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আমদানির অনুমতি নিয়েছেন মিল মালিকদের সংগঠনকেন্দ্রিক নেতারা।
জানতে চাইলে বিসিকের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনুমতি দেয়া হলেও অনেক মিল মালিক এখন লবণ আমদানিতে আগ্রহী নন। তাছাড়া বর্তমানে এর দামও কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ফলে লবণ আমদানি করলে উল্টো লোকসানে পড়তে হবে। তবে সরকারি হিসাবে ঘাটতি থাকায় প্রকৃত ঘাটতির সময়ে আমদানির অনুমতি দেবে না সরকার। এ ধারণা থেকে মিল মালিকদের একটি অংশ সরকারি হিসাব জাহির করে লবণ আমদানির সুবিধা নিয়েছেন।’
১ ডিসেম্বর দেশের আটটি লবণ অঞ্চলের ২৪৭টি প্রতিষ্ঠানকে লবণ আমদানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রধান আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রক দপ্তর। নির্দেশনা অনুযায়ী বিসিকের তালিকাভুক্ত ২৪৭টি মিলকে অনলাইনের মাধ্যমে আমদানি পারমিট (আইপি) নিতে হবে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে অনলাইনে আবেদন করে প্রতি আইপির জন্য ৫ হাজার টাকা ফি পরিশোধ করতে হবে। আবেদন করার সময় সংশ্লিষ্ট মিলকে হালনাগাদ আইআরসি, চলতি অর্থবছরের ট্রেড লাইসেন্স, সংশ্লিষ্ট সমিতির সদস্যপদ সনদ এবং বিসিক অনুমোদিত তালিকায় নাম থাকার প্রমাণ একসঙ্গে জমা দিতে হবে।
বিসিকের তথ্য বলছে, দেশে উৎপাদিত লবণের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবহার হয় বিভিন্ন শিল্প খাতে। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া, বস্ত্র, ডিটারজেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প। বাকি ৫০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করে আয়োডিন মিশ্রণের মাধ্যমে ভোজ্য লবণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও ভোজ্য লবণ প্রক্রিয়াজাত করতে ৩০-৪০ শতাংশ লবণ কমে যায়। এ হিসাবে ভোজ্য লবণের প্রকৃত ব্যবহার ৬-৭ লাখ টনের মতো।
বিভিন্ন সময়ে দেশে সংকটের ফলে বিশ্ববাজার থেকে আমদানির মাধ্যমে লবণ সংকট মোকাবেলা করেছে সরকার। এ বছর মাঠে পর্যাপ্ত লবণ মজুদ থাকায় দাম কম। ফলে বিশ্ববাজার থেকে আমদানির পরিবর্তে দেশের লবণ ক্রয় ও প্রক্রিয়াজাত করা অধিক লাভজনক বলে মনে করছেন মিল মালিকরা। এ কারণে অনুমতি দেয়া হলেও আমদানি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন মিল মালিক থেকে শুরু করে লবণ উৎপাদন ও শিল্পের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিসিক।
চাষীরা বলছেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই লবণ উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়ে যায়। এবার মাঠে মজুদ থাকায় দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। আবার চলতি বছরের প্রলম্বিত বৃষ্টির কারণে অনেকেই মাঠ প্রস্তুত করতে পারেননি। বিগত বছর রেকর্ড লিজ মূল্যে মাঠ বেচাকেনা হয়েছিল। কিন্তু লবণের নিম্নমুখী দাম ও আমদানি অনুমতির কারণে চাষীরা বাড়তি মূল্যে মাঠ ইজারা নিতে রাজি হচ্ছেন না। অন্যদিকে ২০২৪ সালে বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা দরে মাঠ বিক্রির পর এখন দাম কমে যাওয়ায় জমির মালিকদের একটি বড় অংশই অধিক লাভের আশায় মাঠ দিচ্ছেন না। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত লবণ মাঠ প্রস্তুত করতে পারেননি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চাষী, যা এ মৌসুমে লবণ চাষ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
চলতি মৌসুমে ২৭ লাখ ১৫ হাজার টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিসিক। গত মৌসুমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ৬৯ হাজার ১৯৮ একর জমিতে লবণ উৎপাদন করেছিল ৪১ হাজার ৩৫৫ জন চাষী। তবে চাহিদা ও দামের ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছর কয়েক হাজার একর করে লবণ চাষাধীন জমি বৃদ্ধি পায়। একই অনুপাতে চাষীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। তবে মৌসুমের শুরুতেই লবণের দাম কমে যাওয়ায় পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যেতে পারেননি অনেকে। ফলে এ বছরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয়ে রয়েছে বিসিক।
জানতে চাইলে বিসিক কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমের বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে এখনো শতভাগ মাঠ প্রস্তুত করা যায়নি। আবার লিজ মূল্য কমে যাওয়ায় চাষীদের একটি বড় অংশ মাঠে যাননি। তবে গত মৌসুমের ঘাটতি উৎপাদনকে সামনে রেখে এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদনে প্রভাব পড়বে না।’