চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই ২০২৪–নভেম্বর ২০২৫) অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নেওয়া নিট ঋণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে ঋণগ্রহণ কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদহার কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আগ্রহও হ্রাস পেয়েছে। যদিও এই নিট ঋণের বড় অংশ এসেছে নন–ব্যাংকিং উৎস থেকে।
চলতি বছরে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত নেওয়া নিট ঋণের মধ্যে ১০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা এসেছে নন–ব্যাংক সোর্স থেকে। নন–ব্যাংকিং উৎস বলতে নন–ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন, ইন্সুরেন্স কোম্পানি এবং ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বোঝায়।
আর অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। এর এক মাস আগে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৯০০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছিল—অর্থাৎ নিট ঋণ নেননি, বরং উল্টো অর্থ ফেরত দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকারের মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১.০৪ লাখ কোটি টাকা। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে মাত্র ১১.২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক তথ্য অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫.৬২ লাখ কোটি টাকা, যা জুন শেষে ছিল প্রায় ৫.৫০ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "নতুন সরকার গঠিত হলে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে। তখন সরকারের ঋণগ্রহণও বাড়বে।"
ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ডিভিশন (আইএমইডি) জানায়, চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২.৩৮ লাখ কোটি টাকা। তবে প্রথম পাঁচ মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা, যা বার্ষিক লক্ষ্যের ৮.৩৩ শতাংশ।
একজন ব্যাংকার বলেন, "আমদানি কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণচাহিদাও কমেছে। সরকার যখন উন্নয়ন ব্যয় বাড়ায় না, তখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও কম আমদানি করে, ফলে বাণিজ্যিক ঋণের চাহিদা কমে যায়।"
কেন সরকার নন-ব্যাংকিং উৎস থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে?
সরকার সাধারণত ঘাটতি বাজেট মেটাতে বেশি ঋণ নেয় ব্যাংকিং খাত থেকে—বিশেষ করে তফসিলি ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি সময়ে সরকারের সরাসরি ব্যাংক ঋণের চাহিদা কম থাকায় নন–ব্যাংক সোর্স থেকে ঋণ বেশি নেওয়া হচ্ছে এবং এ খাতে পরিশোধও বেশি হচ্ছে।
তিনি জানান, "কিছু ইন্সুরেন্স কোম্পানি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ এই সময়ে বেড়েছে। গ্রামীণফোন, বিকাশসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিল–বন্ডে বিনিয়োগ করছে, একই সঙ্গে বিসিবি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রভিডেন্ট ফান্ডও এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "ঋণের জন্য আমরা অকশন করি, সেখানে তফসিলি ব্যাংক যে হারে রিটার্ন চাইছে, নন–ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো তার চেয়ে কম হারে বিড দিচ্ছে—এ কারণেই ব্যাংক থেকে ঋণ কম নেওয়া হচ্ছে।"
যদিও গত অর্থবছরের বড় অংশে ব্যাংকগুলোর মুনাফা এসেছে সরকারি ট্রেজারি বিল–বন্ডে বিনিয়োগ থেকে। তবে বর্তমানে এসব বিল–বন্ডের সুদহার ১২ শতাংশের বেশি থেকে নেমে ১০ শতাংশের কিছু ওপরে দাঁড়িয়েছে। সেসঙ্গে তফসিলি ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমেছে।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ৪ বছরে সর্বনিম্ন
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সালের অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের অক্টোবরের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.২৩ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৬.২৯ শতাংশ; অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে তা সামান্য কমেছে। এক বছর আগে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছিল ৮.৩০ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, "বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নতুন বিনিয়োগে দুর্বলতা। নতুন বিনিয়োগ না করা হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা কমে যায়। তখন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমে যায়। বিনিয়োগে কোনো ঘুরে দাঁড়ানোর সিগন্যাল নেই। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে ধরে নিতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "আগে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়ার যে প্রবণতা ছিল, তা এখন কমেছে। পাশাপাশি আগে ডলার সংকটের কারণে আমদানি দায় মেটানোতে যে সীমাবদ্ধতা ছিল, তা-ও কিছুটা কেটে গেছে।"
"তবে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি সংকট। অনেক কারখানা গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে," বলেন তিনি।
এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. তৌহিদুল আলম খান বলেন, কিছু ব্যাংক তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির চাপে রয়েছে। এতে তাদের নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ও আগ্রহ কমছে।
"এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ঋণের চড়া সুদহারও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে," যোগ করেন তিনি।
সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা