বাংলাদেশে ব্যবসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কম্পানি প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল। সংস্থাটির চলমান দুই বছরের পুনর্গঠন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে এক সংবাদ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
১৮৩৭ সালে ব্রিটিশ মোমবাতি প্রস্তুতকারক উইলিয়াম প্রক্টর এবং আইরিশ সাবান প্রস্তুতকারক জেমস গ্যাম্বল যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর সিনসিনাতিতে তাদের ব্যবসা একীভূত করার সময় কম্পানিটি গঠিত হয়। বিশ্বের অন্যতম ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) উৎপাদক এই কম্পানি ১৯৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশে ব্যবসা করে আসছে।
দীর্ঘ তিন দশকের এ ব্যবসায়িক যাত্রায় তারা বাংলাদেশের প্রাণ গ্রুপের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে দেশে কারখানাও স্থাপন করেছে। তবে এবার বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তানেও প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে স্থানীয় বাজারে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে তৃতীয় পক্ষের পরিবেশকদের (ডিস্ট্রিবিউটর) ওপর নির্ভর করবে।
পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে পি অ্যান্ড জি তাদের ঘোষিত ৭,০০০ অনুৎপাদন কর্মী ছাঁটাই করবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ২০২৭ সালের মাঝামাঝি নাগাদ তারা বিশ্বব্যাপী তাদের ১ লাখ ৯ হাজার কর্মীর ৬.৪% কমাবে। তাদের লক্ষ্য হলো — ব্যবসায় পুনঃবিনিয়োগের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা।
এই ছাঁটাইয়ের প্রভাব কম্পানির নিজ শহর সিনসিনাতিতেও পড়বে, যেখানে প্রায় ১০ হাজার অফিসকর্মী কর্মরত আছেন।
বাংলাদেশের বাজারে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের বিক্রি করা উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হচ্ছে জিলেট ব্র্যান্ডের রেজর ও গ্রুমিং পণ্য, ওরাল-বি ব্র্যান্ডের পণ্য, প্যাম্পারস বেবি ডায়াপার, হুইসপার স্যানিটারি ন্যাপকিন, হেড অ্যান্ড শোল্ডার ও প্যান্টিন শ্যাম্পু, ওলে ফেস অ্যান্ড স্কিন কেয়ার পণ্য, এরিয়াল ও টাইড ডিটারজেন্ট, মি. ক্লিন ব্র্যান্ডের ক্লিনার ও ভিক্স ব্র্যান্ডের পণ্য।
বাংলাদেশ থেকে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জিলেট ইন্ডিয়ার সঙ্গে পরিবেশক চুক্তি বাতিলের ঘোষণা আসে। গত ৩১ ডিসেম্বর চুক্তি বাতিলের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। জিলেট ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর বাংলাদেশের স্থানীয় পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের (পিঅ্যান্ডজি) পণ্যের একক পরিবেশক এমজিএইচ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডস লিমিটেড (আইবিএল)।
এরই মধ্যে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি আইবিএলকে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা আর চুক্তি নবায়ন করবে না। তবে স্থানীয় পরিবেশক প্রতিষ্ঠানটি চাইলে নিজ উদ্যোগে বিদেশ থেকে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করতে পারে।
এ বিষয়ে এমজিএইচ গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কয়েক মাস আগেই প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পরিবেশক চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত আমাদেরকে জানানো হয়েছে।’
এদিকে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি বাতিলের প্রভাব বাজারে পড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বাজারে কমছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল পণ্যের মজুদ। যাদের কাছে আগের পণ্য মজুদ ছিল তারা এখনো বিক্রি করতে পারছেন। কিন্তু মজুদ ফুরিয়ে গেলে তারা আর নতুন করে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানানো হচ্ছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি সুপারশপ ও বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে দেখা যায় যে তাদের কাছে মজুদ থাকা প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের পণ্যও শেষের পথে। রেজর ও স্যানিটারি প্যাডের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে আর পণ্যের সরবরাহ আসছে না।
ভারতসহ অন্যান্য দেশে উৎপাদিত পণ্য আমদানি করে বাজারজাত করার পাশাপাশি ২০২১ সালে বাংলাদেশে যৌথ বিনিয়োগে কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের পণ্য উৎপাদন শুরু করে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। হবিগঞ্জের অলিপুরে প্রাণ গ্রুপের শিল্প পার্কে এ কারখানা স্থাপন করা হয়। প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্সড পারসোনাল কেয়ার লিমিটেডের (এপিসিএল) সঙ্গে এজন্য যৌথভাবে পণ্য উৎপাদনের চুক্তি করে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। এখানে কম্পানিটির জিলেট ব্র্যান্ডের রেজর উৎপাদন হয়। চুক্তি অনুসারে এ কারখানায় বাংলাদেশের বাজারে বিক্রির জন্য রেজর উৎপাদনের কথা।
প্রাণ গ্রুপ ও প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল যৌথভাবে এ কারখানায় ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারখানাটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু কারখানা স্থাপনের চার বছর পরই বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার এ সিদ্ধান্ত এল। এরই মধ্যে প্রাণ গ্রুপকে তাদের কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। নতুন করে উৎপাদন শুরুর বিষয়েও এখনো কিছু জানায়নি বহুজাতিক কম্পানিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপ প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের (পিঅ্যান্ডজি) কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং করত। চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠানটির পণ্য প্রাণ উৎপাদন করে দিত। জানুয়ারি থেকে সেই উৎপাদন প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির পণ্য উৎপাদনের জন্য আমাদের স্থাপিত কারখানা ও কারখানার যন্ত্রপাতি একই অবস্থায় আছে। পিঅ্যান্ডজি যখন আবার অনুমতি দেবে আমরা উৎপাদন শুরু করব।’
২০২৪ এর জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বৈশ্বিকভাবে ৮৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকায় ৫২ শতাংশ, ইউরোপে ২২, দক্ষিণ আমেরিকায় ৭, চীনে ৭, এশিয়া প্যাসিফিকে ৭ এবং ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ৫ শতাংশ পণ্য বিক্রি হয়েছে।
মূলত পি অ্যান্ড জি-এর এই পদক্ষেপ আসে এমন এক সময়ে, যখন কম্পানির ২০২৪ অর্থবছরের অর্গানিক বিক্রয় বৃদ্ধি সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামা, অধিগ্রহণ বা বিক্রয় বাদ দিয়ে যে বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয়, সেটি অনেকটাই ধীর হয়ে গেছে।
গত জুলাই মাসে পি অ্যান্ড জি জানিয়েছিল, তাদের মূল বাজারগুলো — যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপ — এ বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২%, যেখানে তথাকথিত ‘উদীয়মান বাজারগুলোতে’ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১%।
এর আগে ২০২৩ সালে কম্পানিটি আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া থেকেও তাদের সম্পূর্ণ কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। এই ধারাবাহিক সিদ্ধান্তগুলো ইঙ্গিত করছে যে, পি অ্যান্ড জি বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল পারফরম্যান্স এবং ব্যয় সংকোচনের কৌশলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
সূত্র : রয়টার্স, সিনসিনাতি ও বণিক বার্তা।