যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণায় দেশের রফতানি খাতে মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজারটি কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। কূটনৈতিক ব্যর্থতা, সময়মতো পদক্ষেপের অভাব এবং কৌশলগত দূরদর্শিতার ঘাটতিকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের 'পাল্টা শুল্ক' (Reciprocal Tariff) নীতির আওতায় বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের ওপর এই অতিরিক্ত শুল্ক চাপানো হচ্ছে। existing ১৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে নতুন করে ৩৫ শতাংশ যুক্ত হওয়ায় মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ টাকার পণ্যে ৫০ টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। হোয়াইট হাউজের ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির মেয়াদ শেষে আগামী ১ আগস্ট থেকে এই নতুন হার কার্যকর হওয়ার কথা।
রফতানিকারকদের মতে, সময়মতো ও কার্যকর আলোচনা করতে না পারায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে বেশ কয়েকটি ঘাটতি চোখে পড়ে:
বিলম্বিত পদক্ষেপ: শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র তিন মাসের জন্য তা স্থগিত রেখেছিল। এই সময়ে ভিয়েতনাম ও যুক্তরাজ্য চুক্তি করে ফেললেও বাংলাদেশ কার্যকর আলোচনায় পিছিয়ে পড়ে। ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে কিছু ‘ইতিবাচক বার্তা’ পেয়ে ঢাকার নীতিনির্ধারকরা অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন, যা আলোচনার গতি শ্লথ করে দেয়।
কৌশলগত ভুল: যুক্তরাষ্ট্রকে ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও সেই তালিকা সময়মতো পাঠানো হয়নি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু শর্ত দিয়েছিল, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন—যেসব পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেওয়া হবে, তা অন্য দেশকে দেওয়া যাবে না। এই শর্তগুলো মেনে নেওয়া কঠিন ছিল।
লবিংয়ের অভাব: যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য আলোচনায় সফল হতে শক্তিশালী লবিং অপরিহার্য। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ লবিস্ট নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের চিঠি চালাচালি ও আলোচনা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত আলোচনার ওপর আস্থা হারিয়ে শুল্ক আরোপের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়।
এই শুল্ক কার্যকর হলে দেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পোশাক শিল্পে ধস: দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশের উৎস তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, "৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশি পোশাক কিনতে আগ্রহ হারাবে। এতে রফতানিতে বড় ধস নামতে পারে।"
প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়া: যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি বাজার। এই শুল্কের কারণে ক্রেতারা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা মেক্সিকোর মতো বিকল্প দেশের দিকে ঝুঁকবে।
কর্মসংস্থান সংকট: রফতানি আদেশ কমলে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ওপর, যাদের একটি বড় অংশ নারী।
অন্যান্য খাতে প্রভাব: চামড়া, হোম টেক্সটাইল, প্যাকেজিং, পরিবহনসহ পোশাক খাতের সহায়ক শিল্পগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানিয়েছেন, তারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছেন, যিনি বাংলাদেশকে আলোচনায় আরও ‘সিরিয়াস ও স্পষ্ট’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, "এখনও তিন সপ্তাহ সময় আছে। আমরা চাই দ্রুত একজন লবিস্ট নিয়োগ দেওয়া হোক এবং দরকষাকষিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা হোক।"
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, চুক্তি স্বাক্ষরের আলোচনা চলার মধ্যেই এই ঘোষণা হতাশাজনক হলেও তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিমের মতে, এই সংকট আমাদের শিল্প বহুমুখীকরণের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। পোশাকের পাশাপাশি চামড়া, ওষুধ, আইটি ও কৃষিপণ্যের মতো সম্ভাবনাময় খাতে মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য (২০২৪): প্রায় ১০.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি (২০২৪-২৫): প্রায় ৮.৬৯ বিলিয়ন ডলার (দেশের মোট রফতানির ১৮%)।
প্রধান রফতানি পণ্য: তৈরি পোশাক (প্রায় ৮৫%), হোম টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য, টুপি ইত্যাদি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি: ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা এবং কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে।