শিরোনাম
◈ ভারত যাচ্ছেন জয়, শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হবে? ◈ নগদের সিইও জালিয়াত, পদে থাকতে পারবেন না: গভর্নর ◈ ৮ মাসে তিতাসের ৩৬ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন ◈ শেরপুরে অতি বর্ষণে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কায়, আগাম প্রস্তুতি ◈ বাজেটে তিন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ ড. জাহিদ হোসেনের ◈ পাপন কোথায়? দেশে নাকি বিদেশে? যা জানা গেল ◈ ভারতের নিষোধাজ্ঞায় বেনাপোল বন্দরে  আটকে গার্মেন্টস শিল্পের শতাধিক ট্রাক ◈ বেনাপোল সিমান্তে  ৫০০ গ্রাম হিরোইনসহ ভারতীয় ট্রাক চালক আটক ◈ কাঙ্ক্ষিত সেবা দিয়েই জনগণের মন জয় করতে হবে: ডিএমপি কমিশনার ◈ বেনাপোলে এসএ পরিবহন থেকে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫ মন ভায়াগ্রা পাউডার জব্দ

প্রকাশিত : ১৮ মে, ২০২৫, ০৪:৩০ দুপুর
আপডেট : ১৮ মে, ২০২৫, ১০:১৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র এফটিএ: রপ্তানি প্রবাহে আসতে পারে বড় পরিবর্তন

বাংলাদেশের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের জন্য আলোচনায় রাজী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র—যা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একটি সম্ভাবনাময় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এমন একটি চুক্তি কার্যকর হলে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবাহে নতুন গতি সঞ্চার হতে পারে বলে মনে করছেন অংশীজনরা।

গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোগ সম্পর্কে নিশ্চিত করে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বড় খবর। প্রক্রিয়াটি দ্রুত করতে যুক্তরাষ্ট্র এরমধ্যেই চুক্তির একটি খসড়া চেয়েছে।'

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন আরোপিত বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার বিষয়ে গতমাসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল— যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যেখানে বাণিজ্য সচিবও ছিলেন। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তাব করে ঢাকা। এতে সম্মতি দিয়ে বাংলাদেশের কাছে চুক্তির খসড়া চেয়েছেন ইউএসটিআর কর্মকর্তারা।

বাণিজ্য সচিব বলেন, 'ইতোপূর্বে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রকে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন তারা এতে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু এবার তারা রাজী হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সংবাদ। আমরা নেগোসিয়েশন (আলোচনা) শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি।' তিনি আরও জানান, 'প্রস্তাবিত এফটিএ'র খসড়া তৈরির জন্য আমরা ডেডেকেটেড একটি কমিটিও গঠন করেছি।'

বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১২ মে একটি আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে, যার কাজ হচ্ছে প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) খসড়া তৈরি করা। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ)-কে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে খসড়া প্রণয়ন করে বাণিজ্য সচিবের কাছে দাখিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র; যেখানে দেশের মোট রপ্তানির ১৭.০৯ শতাংশ, এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশের বেশি যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ওভেন পোশাকের প্রায় ২৬ শতাংশ, নিটওয়্যারের ১১.৭১ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইল পণ্যের ১৬.১২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।

তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) খাতের ব্যবসায়ী নেতারা উল্লেখ করেন, এই খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ, যেমন ভিয়েতনাম ও ভারত ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে মাত্র ৭ শতাংশ শুল্কের সুবিধা পাচ্ছে ভিয়েতনাম, যেখানে বাংলাদেশকে ১৫ শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ টিবিএসকে বলেন,  যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে তাদের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান শুল্ক কাঠামোয় বড় বৈষম্য রয়েছে, এতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যে গড় শুল্ক হার মাত্র ৬.১ শতাংশ। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে কাঁচা তুলা ও স্ক্র্যাপ লোহা। এ দুটি পণ্যে শুল্ক হার যথাক্রমে ০ শতাংশ ও ১ শতাংশ।

২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকখাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না। প্রায় ১৫.৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে দেশটিতে।

এই পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেয় যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর;  ট্রাম্পের প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে। ঢাকার অনুরোধের প্রেক্ষিতে যা বর্তমানে তিন মাসের জন্য স্থগিত রেখেছে।

আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ- এরও প্রেসিডেন্ট বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ তুলা, স্ক্র্যাপ, সয়াবিন ও কৃষিপণ্য আমদানি করে, যার বেশিরভাগ হয় শুল্কমুক্ত, নাহয় সামান্য শুল্কে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাই দেশটির সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর হলে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।'

বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান টিবিএসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরে রাজী হলে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য খুবই ভালো খবর। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মেধাস্বত্ব অধিকার, শ্রম মানদণ্ড, পরিবেশগত বিধিমালা ও ব্যবসার সার্বিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে।

গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭.৬০ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭.১৯ বিলিয়ন ডলার, যা এই সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৭.৮৭ শতাংশ। যার বিপরীতে, গত অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এর পরিমাণ ২২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।

ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি চায় বাংলাদেশ

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানানান, বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে ১৩ মে একটি স্টেকহোল্ডার সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রস্তাবিত পাল্টা শুল্ক এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি, এফটিএ সইয়ের কৌশল ও প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়।

বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধিরা বলেছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশ মোস্ট ফেভার্ড নেশন (এমএফএন) ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলে– এ সংস্থার সদস্য অন্যান্য দেশও এসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। তখন অন্যান্য দেশের পণ্যগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রতিযোগিতায় সক্ষম না হলে— দেশটি থেকে বাংলাদেশের বেসরকারিখাতের আমদানি বাড়বে না।

যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ আলোচনা শুরুর একটি প্রস্তাব ওঠে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, এফটিএ স্বাক্ষর করে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ের প্রস্তাব করা হবে।

ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান। টিবিএসকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে, উভয় দেশের পণ্য রপ্তানিতে জিরো ট্যারিফ সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

'যতদিন এফটিএ স্বাক্ষর না হবে, ততদিন বিদ্যমান টিকফা চুক্তির আওতায়— শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করা হবে'- বলেন তিনি।

জাপান ছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরে অগ্রগতি নেই

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ (এলডিসি গ্রাজুয়েশন) সামনে রেখে, সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিলেও – জাপানের সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনায় অগ্রগতি ছাড়া – অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনায় খুব একটা অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে। চলতি মাসেই টোকিওতে জাপানের সঙ্গে পঞ্চম রাউন্ডের আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) স্বাক্ষরের জন্য চতুর্থ দফা আলোচনা হওয়ার পর বছরখানেক ধরে আর কোন অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে। মূলত উভয় দেশই পরস্পরের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দাবি করলেও কোন দেশ এতে রাজী না হওয়ায় আলোচনা থমকে আছে। একইভাবে তৈরি পোশাক পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে রাজী না হওয়ায়, শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রথম দফার আলোচনা হয়েছে।

তবে সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষরের আলোচনা শুরুর আগ্রহ নেই কোন পক্ষের। চীনের সঙ্গে এফটিএ আলোচনা গতবছর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও— তা এখনও শুরু হয়নি।

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর চীনের নেতৃত্বাধীন রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসেপ) ও আসিয়ানে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ চিঠি দিলেও এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও সাড়া পায়নি। এছাড়া, অন্তবর্তীকালীন সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।  উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়