এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাতবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের উপকূলের সুন্দরবনের আলোরকোলে রাসপূজা উপলক্ষে খুলনা রেঞ্জের সম্পদ রক্ষায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। এ বছর ৩ নভেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর তিন দিনব্যাপী আলোরকোলে অনুষ্ঠিত হবে রাসপূজা।সুন্দরবনের দুবলার চরের রাস উৎসবের সময় শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বী পূন্যার্থী ছাড়া কোনো টুরিস্ট যাওয়ার অনুমতি পাবেন না। সেখানে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা, হরিণ শিকার ও প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ রোধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
হাজার হাজার পুণ্যার্থীর আগমনে রাসপূজা হয়ে উঠবে উৎসবমুখর। তাই রাসপূজাকে কেন্দ্র করে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের উদ্যোগে বনজ সম্পদ রক্ষায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে হিন্দু সন্ন্যাসী হরভজন দাস সুন্দরবনের দুবলার চরে রাস পূজার সূচনা করেন। সেই ধর্মীয় আচার থেকেই ধীরে ধীরে “দুবলার চরের রাস মেলা” নামে পরিচিতি পায় এই উৎসব।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে লাখো মানুষের সমাগম হতে থাকে। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীই নয়, দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও যোগ দিতেন। ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, বনাঞ্চলের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। হরিণ শিকারিদের অপতৎপরতাও বাড়তে থাকে।
এই কারণে ২০১৭ সাল থেকে মেলার ব্যাপকতা সীমিত করা হয় এবং রাস উৎসবকে কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রাখা হয়।
এ বছর ৩ নভেম্বর থেকে তিন দিনের জন্য শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের রাসপূজায় প্রবেশের অনুমতি প্রদান করবে বন বিভাগ। এ লক্ষ্যে ২৬ অক্টোবর থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পুণ্যার্থীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচটি নৌপথ। উৎসবকে কেন্দ্র করে বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তাও বাড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, আগামী ৩ নভেম্বর থেকে প্রতিবছরের মতো পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আলোর কোলে অনুষ্ঠিত হবে তিন দিনের রাস উৎসব।
আলোর কোলে নির্মিত অস্থায়ী মন্দিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সনাতন ধর্মের মানুষ এসে এখানে পূজা করবেন তাদের ধর্মের বিধান অনুযায়ী।
ভরা পূর্ণিমায় ৫ নভেম্বর ভোরে সাগরের প্রথম জোয়ারে লোনা জলে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে মেলা।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ বাগেরহাট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরি গণমাধ্যমকে জানান, চলতি বছরের রাস উৎসবে শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই যেতে পারবেন। এর বাইরে রাশ উৎসবের উদ্দেশ্যে কোনো পর্যটক যেতে পারবে না। রাস পূজায় টুরিস্টদের নেওয়ার জন্য কোনো ট্যুর অপারেটরকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
জানা যায়, রাস উৎসব প্রধানত বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রধান উৎসব। শ্রী কৃষ্ণের রাসলীলার অনুকরণে পালিত হয় এই উৎসবটি।
রাস শব্দের অর্থ রস বা আনন্দ, যা শ্রীকৃষ্ণের মধুর রসকে বোঝায়।
জানা গেছে, প্রতি বছর কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণের শুক্লপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পার্থিব জীবনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে সুন্দরবনের শেষপ্রান্তে-বঙ্গোপসাগরের তীরে দুবলারচরে এক নিবিড় পরিবেশে হাজির হন। সেখানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র স্নান করে পবিত্র হয়ে ভগবানের কাছে আরতি জানান সনাতন ধর্মের লোকজন। অসংখ্য হিন্দু নর-নারী গঙ্গাসাগরের মেলার মতো তীর্থস্থান মনে করে এই রাসপূজায় উপস্থিত হন।সুন্দরবনের দুবলার চরে শতবর্ষ ধরে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এ রাস উৎসব পালন করে আসছেন। এক সময় এ রাস মেলায় সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও পরবর্তীতে বনের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি চিন্তা করে সরকার সুন্দরবনে রাস উৎসব উপলক্ষ্যে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, রাসপূজা উপলক্ষে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। স্টেশন কর্মকর্তা ও টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের রাসপূজা শুরুর আগে থেকে টহল জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো হয়রানি ছাড়াই সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন পুণ্যার্থীরা।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের (ডিএফও) এজেডএম হাছানুর রহমান বলেন, এবার রাসপূজায় নির্বিঘ্নে যাতে তীর্থযাত্রীরা যেতে পারেন তার জন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। রাসপূজাকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনে অভিযান পরিচালনা করার জন্য কয়েকটি টিম গঠন করা হয়েছে।রাস উৎসব উদ্যাপন কমিটির সভাপতি ও দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে ইতোমধ্যে আলোরকোলে রাধা-কৃষ্ণের অস্থায়ী মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত পুণ্যার্থীরা সেখানে পূজা-অর্চনা করবেন।
তিনি আরও জানান, উৎসব চলাকালীন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ডিএফও রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “এ বছর রাস উৎসবে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরা যেতে পারবেন। ট্যুরিস্ট বা ট্যুর অপারেটরদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পূর্বে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে হরিণ শিকার ও প্লাস্টিক বর্জ্যে বন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই এবার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।