নিনা আফরিন, পটুয়াখালী: পটুয়াখালীতে প্রায় শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প অসমাপ্ত রেখে পালিয়ে গেছে সাবেক এমপির ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ফলে অর্ধ সমাপ্ত এ সকল প্রকল্প নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে এলাকাবাসী। প্রায় ৯৩ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার ০৫২ টাকা প্রাক্কলনে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কার্যাদেশ পেয়েছিলো পিরোজপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপির ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইফতি ইটিসিএল প্রা:লি:। পটুয়াখালী এলজিইডি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে পটুয়াখালী সদর ও মির্জাগঞ্জ উপজেলার একাধিক সাইটে গিয়ে দেখা যায় কোনো প্রকল্পের ড্রেনের কাজ অর্ধেক করা হয়েছে, কোনো সড়কে খোয়া ফেলা হয়েছে কিন্তু রোলার দিয়ে সড়ক সমান করা হয়নি। কোন কোন সড়ক কার্পেটিং করা হয়নি। আবার কোনো সড়কে মাটি কেটে বেড তৈরী করা হয়েছে কিন্তু খোয়া-বালু কিছুই না দেয়ায় সেখানে বর্ষায় পানি জমে ছোট ছোট পুকুরের মতো গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আয়রণ ব্রীজের কোনোটিতে পিলার বসানো হয়েছে, অ্যাঙ্গেল দেওয়া হয়নি, আবার কোনোটির পিলার-অ্যাঙ্গেল হয়েছে কিন্তু স্লাব দেয়া হয়নি। গত এক বছরের ও বেশী সময় ধরে প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় সীমাহীন দূর্ভোগে পড়েছে এসব এলাকার মানুষ।
পটুয়াখালী এলজিইডি সুত্র জানায়, ২০২১-২২, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এডিপিভুক্ত প্রকল্পের আওতায় পিরোজপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দীন মহারাজের মালিকানাধীন ইফতি ইটিসিএল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ৯৩ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার ০৫২ টাকার মোট ২৩টি প্রকল্পের কার্যাদেশ দেয় পটুয়াখালী এলজিইডি। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে গলাচিপা উপজেলায় ৩টি, মির্জাগঞ্জে ৪টি, কলাপাড়ায় ২টি, দুমকী ১টি, রাঙ্গাবালী ১টি ও সদর উপজেলায় ১২টি। চার বছর পার হয়ে গেলে সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধাবখালী ইউনিয়ন আশ্রয়ন প্রকল্প সংলগ্ন শ্রীমন্ত নদের উপর আরসিসি আয়রন ব্রীজ,কাকড়াবুনিয়া মাহমুদিয়া কারিমিয়া মাদ্রাসার সামনে ১৫ মিটার আয়রন ব্রীজ,বেরেরধন খালের উপর সিকদার বাড়ি মসজিদ রোডে ৪৮ মিটার আয়রন ব্রীজ,উত্তর আমড়াগাছিয়া কাশিনাথ স্লুইস সংলগ্ন ১৮ মিটার আয়রন ব্রীজসহ রামপুরা,মজিদবাড়িয়া,কেওয়া বুনিয়া,গাবুয়া আমড়াঝুড়ি ও দক্ষিন আমড়াগাছিয়া এলাকার উল্লেখিত প্রকল্পগুলোর কাজই শুরু করেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এলজিইডির তরফ থেকে ২৩ টি প্রকল্পের মধ্যে দুটির কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে দাবী করে বাকী প্রকল্পের কাজ ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবী করা হয়। তবে সরেজমিনে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি শতকরা ৫০ ভাগের নীচে প্রতিয়মান হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মহিউদ্দীন মহারাজের পরিবার ৬টি ঠিকাদারী লাইসেন্সের বিপরীতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে(এলজিইড)তে এক চেটিয়া রাজত্ব কায়েম করেছিলো। মহারাজের ছোট ভাই ভান্ডারিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিরাজুল নিয়ন্ত্রন করতেন এই সিন্ডিকেট। এলজিইডিতে মিরাজ-মহারাজ সিন্ডিকেট নামে পরিচিত ছিলেন তারা। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এলজিইডি’র বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ না করেই কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এই দুই ভাইর বিরুদ্ধে।
এ কারনে পিরোজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী,হিসাব রক্ষন বিভাগের কর্মকর্তাসহ সিন্ডিকেটের কয়েকজনের নামে ৮টি মামলা করে দুদক। পিরোজপুর জেলা দূর্নীতি দমন কার্যালয়ের উপ পরিচালক মো: আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান,বিভিন্ন অভিযোগে মিরাজ-মহারাজসহ তার পরিবারের চারজনের নামে আটটি মামলা করেছে দুদক। এসকল মামলায় স্থানীয় এলজিইডি,জেলা হিসাব রক্ষন কর্মকর্তাকেও আসামী করা হয়েছে। সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মহারাজ পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পটুয়াখালী এলজিইডির প্রথম শ্রেণীর এক ঠিকাদার জানান,পটুয়াখালীর যে কাজগুলো স্থবির হয়ে পড়ে আছে তার জন্য মূলত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়। তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে পটুয়াখালীর স্থানীয় ঠিকাদাররা এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করছিলো। যারা এই কাজগুলো করছিলেন তাদের মধ্যে পটুয়াখালী আওয়ামী লীগ ঘারানার অনেক ঠিকাদার যেমন ছিলেন তেমনি পেশাদার ঠিকাদাররাও ছিলেন। তিনি নিজে ইফতি ইটিসিএল এর লাইসেন্সের মাধ্যমে পটুয়াখালী এলজিইডির ১৩ কাজ বাস্তবায়ন করছেন। তিনি জানান,তার নেয়া কাজগুলো ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ সম্পন্ন করে ফেলেছেন। ব্যাংক থেকে ঋন নিয়েছেন যাতে দ্রুত কাজ শেষ করা যায়।
কিন্তু ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তন হলে ইফতি ইটিসিএল’র মালিকরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া যায় এবং দুদকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে দেয় সরকার। আর এতেই স্থানীয় সব সাব-ঠিকাদাররা পড়েন মহাবিপাকে। তিনি জানান তার প্রায় ১৬ কোটি টাকার বিল আটকে আছে এলজিইডিতে। সরকার তদন্ত করে যে বা যারা মাঠে কাজ করছে তাদের বিল প্রদানের ব্যবস্থা করলে খুব দ্রুত কাজ সম্পন্ন হবে বলে দাবী করেন তিনি।
কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কের সদর উপজেলার করমজাতলা থেকে পটুয়াখালী-বাউফল-দশমিনা আঞ্চলিক মহাসড়কের লোহালিয়া সেতুর সংযোগ সড়ক, পৌর শহরের ১নং ওয়াডের বহালগাছিয়া এলাকায় লোহালিয়া ব্রীজ টু হেতালিয়া বাঁধ সড়ক,গলাচিপা উপজেলার ছোনখোলা সড়ক, মির্জাগঞ্জের চরখালী,কাকড়াবুনিয়া, মজিদবাড়িয়া, দক্ষিণ মজিদবাড়িয়া, রামপুরা, কেওয়াবুনিয়া এবং রাঙ্গাবালীর আমলীবাড়িয়া, দক্ষিণ কাজির হাওলা, কাছিয়াবুনিয়া বাজার, দুমকী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও আয়রণ ব্রীজের কাজ সবগুলোরই একই অবস্থা।
গত এক বছর ধরে প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পটুয়াখালী পৌর শহর সংলগ্ন জাফর গাজী(৫৫),আনসার হাওলাদার(৭০),হোসনে আরা বেগম(৬৫)সহ একাধিক স্থানীয় মানুষ জানান,আগে কাঁচা রাস্তা ছিলো তাও ভালো ছিলো। কাঁদার মধ্যে দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারতো। গত এক বছরের বেশী সময় ধরে রাস্তার কাজ বন্ধ। মাটি কেটে রাখা হয়েছে। কোন কোন জায়গায় খোয়া ফেলেছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে মানুষ যে হেটে পাকা সড়কে উঠবে তারও কোন উপায় নাই। এমনকি মসজিদে যে নামাজ পড়তে যাবে তাও তারা যেতে পারছে না।
অভিযুক্ত ইফতি ইটিসিএল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজুল ইসলাম গত বছর ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, এ প্রকল্পের বিষয়ে মহিউদ্দিন মহারাজের শ্বশুর ও তুষখালী ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান শরীফ মো. নজরুল ইসলাম জানান, ওরা তো দেশের বাইরে। দুদকের মামলার আগেই মহারাজ-মিরাজ দেশের বাইরে চলে গেছে। তাদের ঠিকাদারী লাইসেন্স নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষ কাজ করতো। আমি জানিনা এখন কিভাবে কাজ করবে। তাছাড়া পটুয়াখালীতে তাঁদের কাজ আছে এটাই আমাকে কখনও বলেনি। সব কিছুর খবরও আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক পটুয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মানস কান্তি দত্ত জানান,রাষ্ট্রের টাকা হরিলুটকারী এসব ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। এক বছরের বেশী সময় ধরে কাজ বন্ধ হয়ে আছে। তাহলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ এই এক বছরে কি করেছে। তাদের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করে দ্রুত মানুষের দূর্ভোগ লাঘবে তারা কেন পদক্ষেপ গ্রহন করেন নি তাও খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি দ্রুত এসব কাজ সম্পন্ন করে মানুষের ভোগান্তি দূর করতে সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হোসেন আলী মীর জানান,ইফতি-ইটিসিএল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে পটুয়াখালীতে ২৩টি প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। চলমান কাজগুলো গড় অগ্রগতি শতকরাা ৫০ ভাগ। ঠিকাদার দেশত্যাগ করায় এবং তাদের ব্যাংক হিসার ফ্রিজ হওয়ায় ব্যাংকে চেক ডিজঅর্নার হয়। তাই আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সাব ঠিকাদাররা কাজ করছে না। কোন কোন সাব ঠিকাদার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছে কিন্তু ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ থাকায় তারা কোন বিল তুলতে পারছে না। তাই বাকী কাজ তারা করছে না। সার্বিক বিষয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে পত্র দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। তারা যে নির্দেশনা দিবেন সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।