এস. এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এখন চরম পরিবেশগত সংকটে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, শিল্পবর্জ্য, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, পর্যটনের অযাচিত চাপ ও বেপরোয়া নৌযান চলাচলে দিন দিন বিষাক্ত হয়ে উঠছে এই বিশ্ব ঐতিহ্য।
মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় পশুর নদে নিষ্কাশিত বর্জ্য গিয়ে মিশছে বনের নদীতে। এতে মাটি ও পানির দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, হাইড্রোলিক হর্ন ও আলোতে প্রাণীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
দূষণ, লবণাক্ততা ও জলবায়ুর প্রভাব
পরিবেশ ও বন বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় গাছের চারা জন্মানো বন্ধ হয়ে গেছে। সুন্দরবনের জলজ ও স্থলজ পরিবেশে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, পশুর নদে পানির তেলে দূষণের মাত্রা ২০১০ সালের তুলনায় ৬ গুণ বেড়েছে।
শিকার ও বিষ দিয়ে মাছ ধরা—নতুন চ্যালেঞ্জ
বনজীবীদের একাংশ এখনও বিষ দিয়ে মাছ ধরার মতো নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। গত দুই বছরে সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ৩ হাজার ৬৬০ কেজি বিষাক্ত মাছ, ২৯৩টি নৌকা এবং ২২৪ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে বলে বন বিভাগ জানিয়েছে।
একইসঙ্গে হরিণ শিকারও অব্যাহত রয়েছে। শুধু কয়রা উপজেলায় এক বছরে ৫১২ কেজি হরিণের মাংস, একাধিক চামড়া ও মাথা উদ্ধার করা হয়েছে।
পর্যটনের চাপে বন ক্ষতিগ্রস্ত
সুন্দরবনে ৭টি সরকারি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। নতুন করে আরও কয়েকটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু এতে করে গাছ কাটা, প্লাস্টিক বর্জ্য, উচ্চ শব্দ দূষণ—সব মিলিয়ে বিপন্ন হচ্ছে বনের প্রাণ-প্রকৃতি।
বিশেষজ্ঞদের মত
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, “সুন্দরবনের নদ-নদীতে তেলের মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। বনের প্রাণীরা এড়িয়ে চলছে নৌযান চলাচলের রুট। জলবায়ুর প্রভাবে গাছের আগা মরে যাচ্ছে, নতুন চারা জন্মাচ্ছে না।”
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা ড. আ স ম হেলাল উদ্দিন জানান, “৪০% সুন্দরীগাছ ‘আগা মরা’ ও ৫০% পশুরগাছ ‘ঢোর রোগে’ আক্রান্ত। অধিক লবণাক্ততায় এসব গাছ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
প্রশাসনের উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা
বন বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে, শিকারিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যটকদের সচেতন করতে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগের সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, “সুন্দরবন বাংলাদেশের জন্য যেমন অর্থনৈতিক সম্পদ, তেমনি জীবনের অংশ। ইসিএ ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও সেখানে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এভাবে চললে বনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।”