এ এইচ সবুজ, গাজীপুর: গ্রীষ্মের প্রিয় ফল কাঁঠাল—স্বাদে অতুলনীয়, গন্ধে মনভোলা। আর গাজীপুরে উৎপাদিত কাঁঠাল যেন তার অনন্য দৃষ্টান্ত। এ জেলার কাঁঠাল পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের মর্যাদা, যা জাতীয়ভাবে গর্বের ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় এক অর্জন।
রাজধানীর উপকণ্ঠ গাজীপুর যেন এখন কাঁঠালের এক রাজ্য। রাস্তার ধারে, বাজারে, বাড়ির আঙিনায় সর্বত্র কাঁঠালের ছড়াছড়ি। ‘প্রকৃতির মিষ্টি রস, কাঁঠালে ভরপুর দেশ’—এই স্লোগানের প্রতিফলন মেলে শ্রীপুর উপজেলায়। সেখানকার প্রশাসন ইতোমধ্যে কাঁঠালকে ব্র্যান্ডিংয়ে নেয় নানা উদ্যোগ। উপজেলায় নির্মাণ হয়েছে কাঁঠালের একটি বিশাল ভাস্কর্য, যার স্লোগান—‘সবুজে শ্যামলে শ্রীপুর, মিষ্টি কাঁঠালে ভরপুর’।
প্রতি বছর মে-জুন মাসে শুরু হয় কাঁঠালের মৌসুম। জেলার সবচেয়ে বড় কাঁঠাল হাট বসে জৈনা বাজারে। শ্রীপুরের চকপাড়া, টেপিরবাড়ি, রাজাবাড়ি, চন্নাপাড়া, কেওয়া ও কাপাসিয়ার বেগুনি বাজার, আমরাইদ, আড়াল বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে চলে কাঁঠালের জমজমাট বেচাকেনা। এসব হাটে প্রতিদিন রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, হেমায়েতপুর ও উত্তরার পাইকাররা কাঁঠাল কিনতে আসেন।
কাঁঠাল চাষিরা গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে ঠেলাগাড়ি, ভ্যানে করে বাজারে নিয়ে আসেন, বিকেলের মধ্যেই সেসব ফল ট্রাকে তোলা হয় এবং রওনা দেয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও বিদেশে। এই মৌসুমি ব্যস্ততায় জীবন্ত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলায় ৯,১০৩ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়েছে, যার মধ্যে শ্রীপুরেই ৩,৫৫২ হেক্টর। বছরে মোট উৎপাদন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এখানকার প্রধান জাত খাজা, গালা ও দুরসা। উঁচু জমি, বন্যামুক্ত পরিবেশ ও অনুকূল আবহাওয়ায় এই অঞ্চলের কাঁঠাল হয় বড়, মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত।
এই কাঁঠাল শুধু দেশে নয়, পাড়ি জমায় বিদেশেও। নিয়মিত রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ১৫টি দেশে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ব্যবসায়ীরাও গাজীপুরে আসেন সরাসরি বাগান থেকে কাঁঠাল কিনতে।
তবে এমন সম্ভাবনাময় পণ্য হওয়া সত্ত্বেও চাষিরা নানা সমস্যায় পড়ছেন। অনেক বাজারে কাঁঠালের জন্য নির্দিষ্ট স্থান নেই, নেই হিমাগার বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা। ফলে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকার কাঁঠাল নষ্ট হয়ে যায়। ফড়িয়াদের দাপট, প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক ঋণের অভাবও সমস্যার অন্যতম কারণ।
শ্রীপুরের চাষি আব্দুল মালেক বলেন, “সরকার যদি প্রশিক্ষণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে বিদেশে আরও কাঁঠাল রপ্তানি করা যেত।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. রফিকুল ইসলাম খান জানান, গাজীপুরের কাঁঠাল স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মানে অনন্য। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (ইডিসি) সহযোগিতায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরে জিআই স্বীকৃতির আবেদন করা হয়।
২০২৪ সালের ৬ মার্চ, ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য আইন, ২০১৩-এর ধারা ১২ অনুযায়ী, গাজীপুরের কাঁঠাল জিআই জার্নাল-৪৬-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। ৮ মার্চ এটি ডিপিডিটি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে গাজীপুরের কাঁঠাল দেশের ৪৭তম নিবন্ধিত জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
৩০ এপ্রিল, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস-২০২৫ উপলক্ষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গাজীপুরের কাঁঠালকে আনুষ্ঠানিকভাবে জিআই সনদ প্রদান করা হয়।
এই স্বীকৃতি শুধু সম্মানের প্রতীক নয়, বরং সম্ভাবনার এক নতুন দরজা। উপযুক্ত নীতিমালা, হিমাগার স্থাপন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গাজীপুরের কাঁঠাল হতে পারে জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।