পুলক ঘটক: (১) একজন ট্রান্স-নারী বা ট্রান্স-বালিকার মানসিক অবস্থার কথা অনুমান করতে চেষ্টা করছি। পারছি না। কল্পনা করুন, একজন কিশোর সে জন্মেছে পুরুষের শরীরের নিয়ে, কিন্তু তার বুকের ভেতর অবস্থিত হৃদয়টা, তাঁর মস্তিষ্ক, সবকিছুই একজন নারীর। সে নিজেকে ভাবছে নারী, আচরণ করছে নারী হিসাবে বা নারীর মতো, কিন্তু তার শরীর ভিন্ন- সেটি নারীর শরীর নয়। সমাজ চায় সে যেন পুরুষ হিসাবেই বেড়ে ওঠে, পরিবার তাকে জানে পুরুষ হিসাবেই- সেজন্যে তার নারীসুলভ আচরণ সমাজ ও পরিবারের বিবেচিত হয় বিচ্যুতি হিসাবে, লজ্জাজনক আচরণ হিসাবে। একটি কিশোরের দেহে বাস করা সেই কিশোরীটির মানসিক যন্ত্রণাটা কি আপনি অনুভব করতে পারেন!
এই মানসিক অবস্থাটার একটা নাম আছে- জেন্ডার ডিসফোরিয়া (Gender Dysphoria)। আমি খুব বিস্তারিত জানিনা, আমার কাছে একজন মানুষের সেক্সুয়ালিটি বা তার লৈঙ্গিক পরিচয় সাধারণভাবে খুব জরুরী একটা বিষয় মনে হয় না। সমাজে একজন মানুষ তো মানুষই, হোক সে নারী বা পুরুষ বা শারীরিকভাবে নারী আর মানসিকভাবে পুরুষ বা অন্য যাই কিছু। আমি আতঙ্কে হিম হয়ে যাই কেবল সেইসব শিশু কিশোর এবং কৈশোরত্তীর্ণ সেইসব মানুষের কথা ভেবে যারা নিজের পরিচয়টা নিয়ে লড়ছে তার সমাজ তার পৃথিবীর আক্রমণের মুখে অথচ তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই লড়াইটিতে তার পাশে তার বাবা থাকে না, মা থাকে না, ভাই বোন কেউই না।
ভেবে দেখুন এরকম একজন শিশু বা কিশোরের কথা, যে মনেপ্রাণে জানে যে সে একজন মেয়ে কেবল জন্মেছে পুরুষের শরীর নিয়ে, গোটা পৃথিবী যার বৈরি। এই বৈরি পৃথিবীর সাথে হয়তো সে লড়তে পারে, কিন্তু ওর পিতা মাতা যখন ওকে পেটাতে থাকে তাকে সাধারণ ছাঁচে ফেলবার জন্যে তখন ওর চেয়ে অসহায় বিপন্ন প্রাণী আর কে থাকতে পারে? এটা তো অন্যায়, সেই কিশোরটির প্রতি অন্যায়, খুব ভয়াবহ একটা অন্যায়। ওর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি ঘণ্টা মিনিট দিন কতোটা কষ্টের সে কি আপনি কল্পনা করতে পারেন?
(২)
আমি নিজেও শৈশব কৈশোর পার করেছি। আমার দুইটা সন্তান আছে, দুই কন্যা, ওরাও কৈশোর পেরিয়ে গেছে। এখন যখন আমি পেছনের দিকে তাকাই, আমি দেখতে পাই আমি আমি তো এইরকম কিশোরদেরকে দেখেছি, আমার শৈশব কৈশোর যৌবনে দেখেছি, আমার সন্তানদের সমবয়সীদেরকেও দেখেছি। না, আমার সমাজ এইসব শিশু কিশোরদের পাশে দাঁড়ায় না। এমনকি ওদের পিতামাতা ওদের পাশে মমতা নিয়ে দাঁড়ায় না। এই অন্যায়টা আমরা করেই যাচ্ছি যুগের পর যুগ ধরে ক্রমাগত- এখনো করে যাচ্ছি। এইটা তো ঠিক হচ্ছে না। মোটেই ঠিক হচ্ছে না।
দেখেন, আপনার সন্তান তো আপনার সন্তান। তার জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হওয়ার কথা পিতামাতার বুকের মধ্যে। সমাজ সংসার যখন তাকে গঞ্জনা দেয়, সেই সময়টায় যদি ওর কাঁধে পিতার হাত থাকে তাইলেই সে যেন নিরাপদ একটা আশ্রয় পায়। আমরা আমাদের শিশু কিশোরদের কাছ থেকে এই আশ্রয়টাও কেড়ে নিয়েছি। কি অন্যায়! কতোটুকু নিষ্ঠুরতা এটা!
একটা সিনেমা দেখেছি চণ্ডীগড় করে আশিকি। এমনিই সাধারণ একটি বাণিজ্যিক সিনেমা, ভারতীয় হিন্দি ছবি। এই সিনেমায় একজন মুল চরিত্র হচ্ছে এইরকম একটি মেয়ে, সে জন্মেছে ছেলে হয়েছে আর কৈশোর পেরিয়ে অপারেশন ইত্যাদি করে নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ওর মা ওকে অস্বীকার করে, ওকে মানতে চায় না, ওর সাথে কোথাও বলতে চায় না- বলে আমার সন্তান তো ছিল ছেলেটা। কি ভয়ংকর! সিনেমা দেখতে দেখতে আমার চীৎকার করতে ইচ্ছা করে সেই মায়ের উদ্দেশ্যে, ওরে, এই বাচ্চাটা তো তোরই বাচ্চা, তোর পেট থেকেই বেরিয়েছে। সে ছেলে কি মেয়ে নাকি ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছে তাতে কি যায় আসে। তুই তোর সন্তানকে কি করে অস্বীকার করিস!
(৩)
কবে আমরা আমাদের সন্তানকে ওদের প্রাপ্য মমতাটুকু দিতে শর্ত জুড়ে দেওয়া বন্ধ করবো? মায়ের মমতা পিতার ভালোবাসা সেটার জন্যে আবার কিসের শর্ত! গোল্লায় যাক সমাজ জামাত। আমার সন্তান যেভাবে বাঁচতে চায়, যেই পরিচয়েই হোক, সেইভাবে সেই পরিচয়েই বাঁচবে। সমাজের স্ট্যান্ডার্ড মিলল কি মিলল না তার গুল্লি মারি। অন্যায় না করলেই হলো। লিখেছেন: আমার প্রিয়জন তথা প্রিয় লেখক ব্যারিস্টার Imtiaz Mahmood
আপনার মতামত লিখুন :