অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম: নিউরো সায়েন্সে একটি কথা আছে: neurones that fire together wire together. যেসব নিউরন ( স্নায়ু কোষ) একসঙ্গে জ্বলে উঠে, সেগুলো একসঙ্গে (তারের মতো) জড়িয়ে যায়। তার মানে সে স্নায়ু কোষগুলো মিলে একটি সার্কিট তৈরি করে। এভাবে যতোবার সে সার্কিট উদ্দীপ্ত হবে, ততো শক্তিশালী হয়ে উঠবে সে কানেকশন/সার্কিট। কথায় আছে প্রাকটিস মেকস ম্যান পারফেক্ট। এ প্রবাদের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপরোক্ত সূত্র। নিউরো সায়েন্সে আরও একটি কথা আছে ‘use it or loose it’।
একে (ব্রেইনের যেকোনো অংশ) ব্যবহার করো, না হলে এটি হারাবে। (এ বিষয়ে আমার ‘মন ও মানুষ’ বইয়ের ১ম খণ্ডের ১ম অধ্যায়ে একটি আলাদা লেখা রয়েছে, আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন)। আমার বইয়ের সেই অংশের কিছু উদ্বৃতি দিচ্ছি: ‘অনেকটা এ রকম তোমাকে প্রচুর সম্ভাবনা ও সুপ্ত শক্তি দেওয়া হলো। এখন তোমার কাজ হচ্ছে, এগুলোর সঠিক ব্যবহার ও অনুশীলন করে নিজেকে ইচ্ছামতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলা। কে কোন ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে পারবে, পারঙ্গম হবে, তা নির্ভর করে সে কিশোর-কিশোরী কোন ক্ষেত্রটিতে বেশি আগ্রহ নিয়ে চর্চা ও অনুশীলন করে।
যেসব নিউরন ও তার সংযোগগুলো বেশি বেশি ব্যবহৃত হবে সেগুলো টিকে যাবে এবং যেগুলোর কম ব্যবহার হবে বা হবে না সে গুলো শুকিয়ে গিয়ে ঝরে পড়ে যাবে। তাই যে কিশোর-কিশোরী সংগীতে মনোনিবেশ করবেন, খেলাধুলার চর্চা বেশি করবেন, লেখাপড়া ও একাডেমিক চর্চা বেশি করবেন তাদের ক্ষেত্রে ওই বিশেষ নিউরন ও তার সংযোগগুলো শক্ত, মজবুত ও পোক্ত হবে।
অন্যদিকে যারা অলস বিছানায় শুয়ে থেকে ভিডিও গেমস খেলে সময় কাটাবে তাদের ক্ষেত্রে শুধু ওইসব সার্কিটগুলো টিকে থাকবে, বাকিগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে। তবে এই শক্তিশালী কানেকশন পেতে হলে পুরনো, অকেজো স্নায়ু সংযোগগুলোকে কেটেছেঁটে বাদ দিতে হবে, যাতে নতুন জায়গা পাওয়া যায়। একে আমরা বলি ‘synaptic pruning’। মনে রাখবেন আমাদের ব্রেইন একটি বাগান। তবে এ বাগানে ফল, ফুল গজে উঠে না, কিন্তু গজে উঠে স্নায়ু কোষ, স্নায়ু সংযোগ। এই কানেকশন বা সংযোগের মাধ্যমে, নিউরো ট্রান্সমিটারগুলো, যেমন: ডোপামিন, সেরোটনিন প্রভৃতি চলাচল করে।
মাইক্রো গ্লিয়াল কোষগুলো (glial cell) ব্রেইনে মালি হিসেবে কাজ করে। এগুলো নির্দিষ্ট স্নায়ু কোষে সিগনাল পাঠানোকে দ্রততর করে। তবে অন্য গ্লিয়াল কোষগুলো পরিত্যক্ত আবর্জনা সরিয়ে ফেলার কাজ করে (waste remover)। এগুলো আগাছা উপড়ে ফেলা, ক্ষতিকর বস্তু বিনষ্ট করা, মৃত ঝরে পড়া পাতা জড়ো করার কাজ করে। এক কথায় আপনার মনবাগানের ‘মালি’ হচ্ছে এই গ্লিয়াল কোষগুলো। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এগুলো কীভাবে জানে কোন সংযোগগুলো ছেঁটে বাদ দিতে হবে? গবেষণায় দেখা গেছে যেসব স্নায়ু সংযোগগুলো কম ব্যবহৃত হয়, সেগুলো protein c1q দ্বারা চিহ্নিত হয় (মার্ক)। মাইক্রো গ্লিয়াল কোষগুলো যখন এই মার্কগুলো চিহ্নিত করতে পারে, এগুলো তখন সে প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয় ও সেগুলো ধ্বংস করে। তারা অব্যবহৃত সংযোগ গুলো ছেঁটে বাদ দেয়। এভাবে আমাদের ব্রেইন নিজের জন্য নতুন জায়গা করে নেয়, যাতে নতুন ও শক্তিশালী সংযোগ তৈরি করে নিতে পারে। ফলে আমরা নতুন বিষয়ে শিখতে পারি।
ঘুম দরকারী: কখনো কি আপনার মনে হয়েছে ব্রেইন জ্যাম হয়ে রয়েছে? নতুন চাকরির শুরুতে, কোনো প্রজেক্টে গভীরতা মনোযোগ দেওয়ার সময় আপনার ঘুম ভালো নাও হতে পারে। এভাবে আপনার ব্রেইন পূর্ণ থাকতে পারে, জ্যাম লেগে যেতে পারে। আপনি যখন নতুন জিনিস শিখেন, তখন আপনার ব্রেইন নতুন কানেকশন তৈরি করে। কিন্তু তখন সেগুলো ততো পোক্ত থাকে না। সেগুলো হয় এডহক কানেকশন। আপনার ব্রেইনকে ওই সংযোগের অনেক অংশ কেটেছেঁটে বাদ দিতে হয় ও শক্তিশালী পথ তৈরি করতে হয়। এটি তেমনটি করে যখন আপনি ঘুমে থাকেন। ও ঘুমের সময় আপনার ব্রেইন মন বাগানের ঝরা পাতা, আবর্জনা সরিয়ে ফেলে। তখন স্নায়ু কোষ ৬০ শতাংশের মতো কুচকে যায় (shrinks), যাতে জায়গা তৈরি হয়। তখন গ্লিয়াল মালি এসে সে পরিত্যক্ত অংশ ছেঁটে বাদ দিয়ে বাগান পরিষ্কার রাখে। কখনো কি সারা রাত ভালো ঘুমের পর আপনার মনে হয়েছে যে আপনি স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে পারছেন, দ্রত চিন্তা করতে পারছেন?
এমনটি হয় কেননা, সারারাত মন-বাগানের আবর্জনা পরিষ্কার হওয়াতে যথেষ্ট জায়গা তৈরি হয়েছে। আপনি নতুন তথ্য নির্মাণ করতে পারছেন। নিদ্রাবঞ্চিত ব্রেইন দিয়ে চিন্তা করা মানে, ঘন জঙ্গলে দা, কুড়াল দিয়ে ঝোপঝাড় কোপানো, যেখানে পথ ভালো করে দেখা যায় না, আলো সব জায়গায় পৌঁছায় না। তাই তখন চিন্তা পথ খুঁজে পায় না, দিকহারা মনে হয়। এ কারণে দুপুরে ১০-২০ মিনিটের হাল্কা ঘুমের দরকার। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া ব্রেইন হচ্ছে সেন্ট্রাল পার্কের মতো যেখানে পথ পরিষ্কার, এক পথের সঙ্গে অন্য পথের সংযোগ স্পষ্ট, গাছগুলো সঠিক জায়গায় স্থাপিত, যা দূর থেকেও দেখা যায়। এমনটি হচ্ছে বল বর্ধক, তেজোবর্ধক, পুষ্টিদায়ক আবহাওয়া, চিন্তা যেখানে অবাধে ছুটতে পারে, বৃদ্ধি পেতে পারে।
যা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন সেদিকে গভীর মনোনিবেশ করুন: যে সংযোগগুলো আপনি কম ব্যবহার করছেন, সেগুলো ব্রেইন ‘রি- সাইক্লিং’ এর জন্য মার্ক করে রাখে। আর যেগুলো আপনি নিয়মিত ব্যবহার করেন সেগুলোতে পানি ঢালা হয়, অক্সিজেন দেওয়া হয়। তাই সেগুলো শক্তিশালী হয়। যদি আপনি সারাক্ষণ ভিডিও গেম খেলেন, পড়াশোনা কম করেন, ভেবে দেখুন আপনার ব্রেইন রিসাইক্লিং-এর জন্য কোনো স্নায়ু সংযোগকে মার্ক করবে? যদি আপনি কর্মস্থলে সংসারে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কলহে লিপ্ত থাকেন, নিজের মূল কাজ বাদ রেখে বা প্রজেক্টে কম মনোযোগ দেন তাহলে আপনার ব্রেইন ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার স্নায়ু সংযোগকে বেশি শক্তিশালী করবে। প্রজেক্টে কম উদ্ভাবনী চিন্তা আসবে, সম্পর্ক উন্নয়নে কম সহযোগিতার মনোভাব থাকবে।
যা গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিন। আপনার মন বাগানের মালি অপ্রয়োজনীয়, গুরুত্বহীন সংযোগগুলো ছেঁটে বাদ দিয়ে, আপনার কাক্সিক্ষত স্বপ্নগুলোর বীজে জল দেবে, অক্সিজেন দেবে, দ্রত বেড়ে উঠতে, শক্তিশালী হয়ে বেড়ে উঠতে অনুুকূল আবহাওয়া দেবে। এ ভাবে মন বাগানকে মনমতো সাজান। লেখক : মনোবিদ