কাকন রেজা: কথিত নারীবাদের বীভৎস চেহারা হলো, ‘তসলিমা নাসরিন’। মুক্তচিন্তার কথা বলে কর্তৃত্ববাদী চিন্তার যে কদর্য প্রয়োগ আকাক্সক্ষা তা হলো তসলিমার মালালার বিয়ে নিয়ে কথা বলা। যারা বলেন মানুষের স্বাধীনতার কথা। যারা সমকামিতাকে সমর্থন করেন। যারা মেহনের পশুবৃত্তিকেও দোষের ভাবেন না। তারাই মালালার পছন্দকে অস্বীকার করেন। তার ব্যক্তি সত্তা ও স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং তা তাদের পছন্দের সাথে না মেলার কারণেই।
নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই বিয়ে করেছেন তার পছন্দের একজনকে এবং সে একজন পাকিস্তানি, তাতেই আপত্তি তসলিমার। মালালা নিজে পাকস্তানি, সে নিজের দেশের একজনকে বিয়ে করবে, তাতে আপত্তি কোথায়? মালালাকে কেন একজন শ্বেতাঙ্গকে বিয়ে করতে হবে, কেন একজন ইংরেজি জানাকে শ্রেষ্ঠ মানতে হবে নিজের দেশের মানুষের চেয়ে! তসলিমারা যে পাত্রে খান সে পাত্রই ফুটো করেন। ভারতে থাকেন, কথা বলেন স্বদেশী আন্দোলনের উল্টো সুরে। বলেন, ‘মালালার উচিত ছিল একজন হ্যান্ডসাম প্রগতিশীল বৃটিশ ছেলের সঙ্গে প্রেম করা’। তাহলে উপমহাদেশের বেশিরভাগ মানুষই কি প্রতিক্রিয়াশীল?
মালালা তো তসলিমা নন, যিনি সবকিছুতেই নিজের দেশের সংস্কৃতির চিন্তাকে নিচু করে দেখাবেন, বিপরীতে পানি ঢালবেন শিবলিঙ্গের মাথায়। নিজের দ্বিচারিতাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার নামই কর্তৃত্ববাদিতা। প্রকারান্তরে যা মৌলবাদিতার ছুপা রূপ। তসলিমা নাসরিনরা সেই ছুপা রুস্তম যারা বিরোধিতার নামে মৌলবাদিতাকে প্রমোট করেন। পাকিস্তানের মেয়েদের এক ব্যান্ড গ্রুপের কনসার্ট দেখলাম ইউটিউবে। জিন্স, শার্ট আর টি-শার্ট পরা দারুণ স্মার্ট সব মেয়ে মঞ্চ দাপিয়ে গান গাচ্ছেন, বাজাচ্ছেন। হাজার হাজার মানুষ সেই কনসার্ট দেখছেন। আমি ভারতের ক্ষেত্রে এমনটা দেখেনি। মেয়েদের এতো স্মার্ট পারফরমেন্স ভারতের ক্ষেত্রে অনেকটাই অসম্ভব। অন্তত কাঁচুলি আর লেহেঙ্গা পরে তা একেবারেই সম্ভব নয়। শাড়ি পরে তো আরো নয়।
না, পাকিস্তানের গুনগান করতে বসিনি, সত্যটা বললাম। সত্য না বলতে বলতে, আমরা মিথ্যার একটা আবরণ তৈরি করেছি। আমাদের নিজেদের নিজেরা বিদেশের কাছে মৌলবাদী প্রমাণ করছি। নিজেদের সাথে নিজেদের লড়িয়ে দিয়ে নেপোরা দই মেরে নিচ্ছে। অথচ আমাদের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটা কেউ সামনে তুলে ধরছে না। বছরের দুই একটা ঘটনা দেখিয়ে প্রতিদিন পরস্পরের সহমর্মিতার চিত্রটাকে আউট অব ফোকাস করে দিচ্ছে। যে দুই বন্ধু এক সিগারেট ভাগ করে নিচ্ছে, এক কাপ চাকে কাপ-পিরিচে ভাগ করে খাচ্ছে। কাঁধে কাঁধ রেখে একসাথে কাজ থেকে বাড়ি ফিরছে। একজনের অসুস্থতায় আরেকজন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। এমন সব সম্প্রীতির চিত্রকে সাংস্কৃতিক উগ্রপন্থীরা হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে দিচ্ছে। চিহ্নিত করছে এক বন্ধুর মৃত্যুতে অন্য যে বন্ধটি কাঁদছে সে হিন্দু মৃতজন মুসলমান, এভাবে। এই যে বিভাজনের অসভ্য চিন্তা এটাই আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। আর অবক্ষয়ের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে তসলিমা নাসরিনের মতন বুদ্ধিভ্রষ্ট কিছু মানুষ।
যারা মানুষের স্বাধীন চিন্তা বলতে বোঝে, তাদের মতো করে ভাবাকে। যারা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বলতে বুঝে অবাধ যৌনতা। যার ফলেই ঈদ আর হোলিতে উৎসবের নামে নিগৃহিত হয় নারীরা। স্বাধীনতার নামে সহকর্মী নারীকে ভোগ করে অফিস বস। যারা জিন্স, শার্ট, টি-শার্টকে আধুনিক মানতে নারাজ। তাদের স্বাধীনতা ক্লিভেজ আর নাভি প্রদর্শনে। তাদের স্বাধীনতা মদ্যপানে, যা চিকিৎসাশাস্ত্র বিষ বলে মানে। মেয়েদের সিগারেট ফোঁকা তাদের মতে স্বাধীন কার্যক্রমের অংশ এবং তা ক্যান্সারের কারণ হলেও। এসবে নিষেধ করা যাবে না। অথচ মালালা কাকে বিয়ে করবে না করবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে। সে কেমন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হবে তা নির্ধারণ করবে তসলিমার মতন উগ্রপন্থী সাংস্কৃতিক মৌলবাদীরা। আজব! যাদের কাজই আরেকজন খুঁচিয়ে উত্তেজিত করে ঝগড়া বাঁধানো। সে ঝগড়াকে নিয়ে যাওয়া সংঘাতের পর্যায়ে। যে সংঘাত আজ পর্যন্ত ধ্বংস ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি। পারবেও না।
উগ্রপন্থা যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক, তেমনি সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও। আইসিস, আরএসএস কিংবা হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের মতোই বিপজ্জনক তসলিমা নাসরিন ও তাদের অনুসারীরা। যারা নিজের চিন্তাকেই শুধু মুক্তচিন্তা বলে মানেন। আর সেই চিন্তাতেই মানুষকে বাধ্য করতে চায়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট