অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে শিক্ষক বোর্ডে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। সংস্কৃত বিভাগ থেকে মাস্টার্স করে সংস্কৃত লিখতে বা বলতে পারে না। এটা এখন সংবাদ। কিন্তু এটা কি কেবল ওই বিভাগেরই সমস্যা? পদার্থবিজ্ঞান থেকে পাস করে কতোজন পদার্থবিজ্ঞান বোঝে? গণিত বিভাগ থেকে পাস করে কতোজন গণিত বোঝে? উর্দু ও পালি বিভাগ থেকে পাস করে কতোজন উর্দু ও পালি বলতে ও লিখতে পারে? ইংরেজি বিভাগ থেকে পাস করে কতোজন সহিভাবে ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারে? আরবি বিভাগ থেকে পাস করে কতোজন আরবি সহিভাবে বলতে ও লিখতে পারে? সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড. মাধবী রানী চন্দ ঠিকই বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যে দিনদিন খারাপ হচ্ছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অনেকেই মুখস্থ করে পাস করে ফেলে।’ মান যে খারাপ হচ্ছে এটা কি নতুন কোনো কথা? অনেক দিন ধরেই আমরা টের পাচ্ছি মান খারাপ হচ্ছে। সমস্যা হলো মান ভালো করার কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।
সেই ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে যেই পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি মোটা দাগে সেই পদ্ধতি আজও বলবৎ আছে অথচ বিশ্বে এ সকল বিষয়ে বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রশ্ন পত্রের মানই নির্ধারণ করে শিক্ষার্থীর মান। মুখস্থ করে যে কেউ ভালো রেজাল্ট না করতে পারে সেই রকম প্রশ্নপত্র নির্ধারণ ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা জরুরি। ১০০ বছরেও আমরা এই কাজটি করতে পারলাম না। দ্বিতীয় পরীক্ষক পদ্ধতি যতোদিন থাকবে ততোদিন প্রশ্নপত্রের মানের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। তাছাড়া উন্নতমানের প্রশ্নের জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের শিক্ষক নিয়োগ। আমরা শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রমোশন পদ্ধতিতেও ১০০ বছরেও তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন পদ্ধতি এক স্তরে করা হয়। অর্থাৎ একটি মাত্র নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে এটি হয় এবং সকল বিভাগের সকল নিয়োগ বোর্ডের প্রধান থাকে হয় ভিসি কিংবা প্রো-ভিসি। এর মাধ্যমেই রাজনীতিকরণ ইনজেক্টেড হয়। শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি বহু স্তরে যাচাইয়ের মাধ্যমে করা উচিত। তাতে ভুলের সম্ভাবনা কমে যাবে এবং একই সঙ্গে রাজনীতিকরণও কিছুটা কমবে।
প্রথমত: পিএইচডি ব্যতীত কাউকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতাকে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা উচিত অথচ এখানে পোস্ট-ডককে কোনো হিসাবেই ধরা হয় না। কেবল যদি একটি নিয়ম করা হয় যে ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ৪০০-র মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এবং পিএইচডি + ৩টি পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা থাকলে তাকে সরাসরি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলেই মানসম্পন্ন অনেক শিক্ষক পাবো। এ ক্ষেত্রেও সবাই যে সমপরিমাণ ভালো হবে এমন গ্যারান্টি নেই। তবে স্টাটিস্টিক্যাললি অধিকাংশই ভালো পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় লাভ যেটি হবে সেটি হলো নিয়োগ পদ্ধতি থেকে রাজনীতি বিদায় হবে। এটুকুই করে দেখেন। দেখবেন শিক্ষার মান এক ধাপে অনেক উন্নত হয়ে গেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় সমস্যা হলো গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম যেমন পরীক্ষা পদ্ধতি, উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা কখনো যুগোপযুগী করার চেষ্টা করা হয় না। যা কিছু বিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত না হবে তাদের মান কমতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়