অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
এবার যখন সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম সেখানে দেখলাম পুরো সৈকতজুড়ে বেশ অনেকেগুলো কুকুরের দল। একেকটি দলে ৫ থেকে ১০টি পর্যন্ত কুকুর দেখেছি। এই কুকুরগুলো যদি সৈকতে কখনো একা কাউকে পায় তাহলে তার পিছে লাগতে পারে। একই ঘটনা ঢাকা শহরের অন্যত্রও দেখেছি। অন্যান্য প্রাণী যেমন সিংহ, বাঘ, হায়েনা, শেয়াল, তারাও একা থাকলে একরকম আচরণ আর অনেক দলবদ্ধ থাকলে অন্যরকম হিংস্র আচরণ করে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে মিছিলে যোগ দিয়েছি। দেখেছি মিছিলের আমি আর একা আমি এক মানুষ না। এইগুলোকেই বলে কমপ্লেক্স সিস্টেমের emergent behavior! Mob beating-I GKwU emergent behavior! তবে এটি কোনো সভ্য সমাজের লক্ষণ নয়। নিশ্চয়ই সবার মনে আছে যে এক মা তার কন্যাকে স্কুলে ভর্তি করাতে এসে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যায়। কল্পনা করা যায় যে একটি মা তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে আসলো আর একদল নরপিশাচ তাকে ছেলেধরা বলে গণধোলাইয়ের শিকার করলো। এই রকম গণধোলাই বা গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা বাংলাদেশে এটিই প্রথম নয় আর এটিই শেষ হবে না। পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজে এটি কল্পনাও করা যায় না। যেই সমাজে যতো বেশি অশিক্ষিত বর্বর সেই সমাজে এই ধরনের গণধোলাই বা গণপিটুনি ততো বেশি ঘটে। গুজব ছড়িয়ে লংকাকাণ্ড বাধিয়ে দেওয়াও অসভ্য সমাজের স্বাক্ষর।
অশিক্ষিত মানুষ পশুসম। অশিক্ষিত মানুষই আমাদের সরকাররা চায়। তাইতো তারা কখনো মানুষকে সত্যিকারের শিক্ষিত করতে শিক্ষায় যথেষ্ট বরাদ্দ দেয় না। সর্ব স্তরের শিক্ষকদের বেতন গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন। অথচ আমরা নাকি জিডিপির গ্রোথে বিশ্বে বিস্ময়। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে সবার ওপরে। সরকার যদি জনগণকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইতো তাহলে শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতো। সরকার যদি জনগণকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইতো তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকার দুর্নীতি বরদাশত করতো না। সরকার যদি জনগণকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইতো তাহলে সরকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে রাজনীতি ঢোকাতো না। গভর্নিং বডির নামে প্রত্যেকটি স্কুলের ভেতরে রাজনীতি আর টাকার খেলা ঢুকিয়ে দিয়ে শিক্ষার যে আসল মন্ত্র সেটাই নাই করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাকে কলুষিত করার ফলাফল কী ভয়ানক তা আমরা প্রতিমুহূর্তে টের পাচ্ছি। এই যে একজন পূজামণ্ডপে হনুমানের কোলে কোরআন রেখে এসে ইচ্ছে করে সবাইকে উত্তেজিত করে মব তৈরি করে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাতে পারা কি সভ্য সমাজের লক্ষণ? সমাজ একটা কোঅপারেটিভ কম্পেক্স সিস্টেম। এখানে নিজে ভালো থাকতে হলে অপরকে ভালো থাকতে সাহায্য করতে হবে। আবার একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টির বোঝানোর চেষ্টা করি। এক শিক্ষক তার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের হাতে একটি করে বেলুন দিয়ে সেটাতে তাদের নাম লিখে ফুলিয়ে মুখ বন্ধ করতে বলে। তারপর সকলেরই যখন এই কাজটি করা শেষ হয় সবাইকে এবার বললেন,... ওপরে ছেড়ে দিয়ে মিক্সড করতে। তারপর ৫ মিনিটের মধ্যে সবাইকে তাদের নিজ নিজ নাম লেখা বেলুনটি খুঁজে বের করতে বললেন। দেখা গেলো একটা হট্টগোল লেগে গেলো এবং কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। এবার অধ্যাপক বললেন তোমরা থামো এবং আমার কথা শোনো। এবার তোমরা হাতের কাছে যেই বেলুনটাই পাও সেটা ধরে যার নাম লেখা সেটি তাকে দিয়ে দাও। দেখা গেলো অতি অল্প সময়ের মধ্যে সবাই তাদের নিজ নিজ লেখা বেলুনটি পেয়ে গেলো। সবাই যখন সবাইকে সাহায্য করে কাজটা সহজ হয় এবং সবাই ভালো থাকে।
অধ্যাপক এবার বললেন, একেকটি বেলুন হলো একেকটি হ্যাপিনেস। আমরা কখনোই আমাদের হ্যাপিনেস খুঁজে পাবো না যদি সবাই কেবল নিজের হ্যাপিনেস খুঁজি। কিন্তু আমরা যদি অন্যের হ্যাপিনেস খুঁজে পেতে সাহায্য করি পরিশেষে আমরা সবাই সবার হ্যাপিনেস খুঁজে পাবো। আজ পর্যন্ত আমাদের কোনো সরকারই চায়নি আমাদের জনগণ তাদের হ্যাপিনেস খুঁজে পাক। তারা মনে করে তাহলেতো তাদের রাজনীতি থাকবে না। অথচ যে করবে সে ইতিহাস রচনা করতে পারতো। স্বর্ণাক্ষরে তার কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকতো। এটা বোঝার জন্য যেই ঘিলু দরকার আমাদের সরকারদের সেই ঘিলুই নেই। তারা দ্রুত ফল পেতে চায়। তারা জনগণকে বলদ বানিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়