বছরের অন্য দিনের মতো,আজকের দিনটি সাধারণ হলেও বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য দিন। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। একটি সম্ভাবনার অঙ্কুরোদগমের পূর্বেই, বিনষ্ট করে দিলো পাকিস্তানি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ এদেশীয় কিছু সেনা কর্মকর্তারা। মাত্র এগার বছর বয়সে চিরতরের জন্য স্তব্ধ করে দিলো একটি অমিয় সম্ভাবনার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আর এই ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে সেদিন রেহাই পাননি ছোট্ট রাসেলও। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তবে হতে পারতেন ৫৮ বছরের এক পরিণত রাজনীতিক কিংবা অন্য কিছু। দৃঢ় প্রত্যায়ী,সাহসী ছোট্ট রাসেলকে পরিণত হতে দিলো না ১৫ আগস্টের ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের খুনিরা। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা এতোটা শঙ্কিত ও ভীত ছিলো যে,বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের মাত্র চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী শেখ রাসেলকে হত্যা করতে পিছপা হয়নি। খুনিরা জানতো, এই ছোট্ট রাসেল যদি বেঁচে থাকে তবে সে একদিন এর বিচার করবেই। এজন্যই খুনি ও খুনিচক্র পরিকল্পনামাফিক ১১ বছরের এক উচ্ছল শিশুকেও তারা বলির পাঠা বানাতে কুন্ঠাবোধ করেনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শেখ রাসেল। সবার ছোট হওয়ার কারণে রাসেলের আদর-সোহাগ-ভালোবাসার কমতি ছিলো না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা ’ বইটিতে শেখ রাসেলের জন্ম, নামকরণ, বেড়ে উঠা ইত্যাদি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। যা আমার মতো পাঠক হৃদয়ে নাড়া দেয়। লেখক ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা ’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ির আমার শোয়ার ঘরে। দোতলা তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করেছেন। একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিলো রাত দেড়টায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এরমধ্যে বার্ট্রান্ড রাসেলের বইও পড়তেন। আর রাসেলের বই পড়ে ফজিলাতুন নেছাকে ব্যাখা করে শোনাতেন। এর ফলে ফজিলাতুন নেছা রাসেলের দর্শন-চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছোট ছেলের নাম রাখেন রাসেল।
বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দিলে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে ১৯৬৬ সালের ৮ মে গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। কোনো রাজবন্দির সঙ্গে দেখা করতে হলে জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। এসময় ফজিলাতুন নেছা পরিবার নিয়ে বঙ্গন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে গোয়ান্দারা সবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন, এমনকি দেড় বছরের শিশু শেখ রাসেল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করায় ক্ষুব্ধ হন ফজিলাতুন নেছা। তখন তিঁনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘বাপের পেছনে গোয়েন্দা লেগেছিলো ২৮ বছর বয়সে, কিন্তু ছেলের পেছনে লাগলো দেড় বছর বয়সেই।’ এরপর শেখ রাসেল আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা ’ বইটিতে শেখ হাসিনা আরো উল্লেখ করেছেন, মহান স্বাধীনতার বছরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার পর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছাসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। এসময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শেখ রাসেলকেও বন্দী করে রাখা হয়। শেখ রাসেল এসময় পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য কান্নাকাটি করতো। তাছাড়া বড় দুই ভাই, বিশেষ করে শেখ কামালকেও পেতো না। এতে তার কষ্ট আরো বেড়ে যেতো।
শেখ রাসেলের জন্মের সময় পিতা শেখ মুজিব চট্টগ্রামের এক জনসভায়। এরপর রাজনৈতিক কর্মসূচীতে দেশে ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করা , জেলে যাওয়া ইত্যাদি কারণে শেখ রাসেল পিতা শেখ মুজিবকে খুব একটা কাছে পেতেন না। এরপর স্বাধীন দেশে বড় হতে থাকা শেখ রাসেল অন্য সাধারণ ছাত্রের মতো কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। এসময় তাকে বাড়িতে পড়ানোর জন্য একজন গৃহ শিক্ষক রাখা হয়। শেখ রাসেল গৃহশিক্ষককে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো সম্মান করতেন। পড়াতে আসলে গৃহশিক্ষককে দুটো মিষ্টি খেতে হতো, আর মিষ্টি না খেলে সে পড়তো না। এককথায় শেখ রাসেল অতিথিপরায়ন ছিলেন। শেখ রাসেল টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে গেলে ছোট ছোট বাচ্চাদের জড়ো করে ডামি বন্দুক নিয়ে প্যারেড করাতো। এসময় প্যারেড শেষে তাদেরকে খাবার কিনে দিতো এবং ঢাকা থেকে তাদেরকে দেওয়ার জন্য জন্য কাপড় নিয়ে যেত। ছোট চাচা শেখ আবু নাসের তাকে এক টাকার নোটের বান্ডিল দিতেন। যা দিয়ে সে গ্রামের বন্ধু ও বাচ্চাদের লজেন্স কিনে দিতেন।
বাবার সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো, পড়াশোনা, খেলার সাথীদের সঙ্গে খেলা করে বড় হচ্ছিলো ছোট্ট রাসেল। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস ছোট্ট উচ্ছল ছেলেটার জীবনটা একেবারেই ছোট থাকতেই শেষ করে দিলো খুনিরা। এমন দুরন্ত,তেজস্বী ও মানবিক এক ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মুকুলেই ঝরে গেলো। আর এর জন্য গোটা বাঙালি জাতি আজও ধিক্কিত। এবছর থেকে শেখ রাসেলের জন্মদিনটিকে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে জাতীয়ভাবে পালন করা হবে। এছাড়া ১৮ অক্টোবর শিল্প,সাহিত্য, ক্রীড়া,সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিতে জাতীয় পদক প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাকিস্তান ও বিদেশি মদদপুষ্ট দেশীয় কিছু নরঘাতকের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে , ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর বেলায় বাবা-মা, ভাই-ভাবী,চাচাসহ পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে নিহত হন শেখ রাসেল। আজ এ অমিয় সম্ভবনার ৫৮তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা