শিরোনাম
◈ এলডিসি থেকে উত্তরণ: আরও তিন বছরের সময় চাইছে বাংলাদেশ ◈ জাপানে জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সিদ্ধান্ত নিল অন্তর্বর্তী সরকার ◈ ১৭ বিয়ের ঘটনায় মামলা, সেই বন কর্মকর্তা বরখাস্ত ◈ বিএনপি নেতাকে না পেয়ে স্ত্রীকে কু.পিয়ে হ.ত্যা ◈ বাংলা‌দেশ হারা‌লো আফগানিস্তানকে, তা‌কি‌য়ে রই‌লো শ্রীলঙ্কার দিকে  ◈ রোজার আগে নির্বাচন দিয়ে পুরোনো কাজে ফিরবেন প্রধান উপদেষ্টা ◈ ঋণের চাপে আত্মহত্যা, ঋণ করেই চল্লিশা : যা বললেন শায়খ আহমাদুল্লাহ ◈ একযোগে এনবিআরের ৫৫৫ কর্মকর্তাকে বদলি ◈ আবারও রেকর্ড গড়ল স্বর্ণের দাম, ভরিতে বেড়েছে ৩ হাজার ৬৭৫ টাকা ◈ ভারতের নেপাল নীতিতে 'রিসেট বাটন' চাপলেন মোদি, শিক্ষা বাংলাদেশের কাছ থেকে

প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০২:৩৯ রাত
আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এলডিসি থেকে উত্তরণ: আরও তিন বছরের সময় চাইছে বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। সীমিত সম্পদ, দুর্বল অবকাঠামো, দারিদ্র্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতির কারণে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে গত পাঁচ দশকে দেশটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, মানব উন্নয়ন সূচকে উন্নতি এসেছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে এবং রফতানি খাতে বৈচিত্র্য এসেছে। এসব অর্জনের ভিত্তিতে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।

তবে সময় যত ঘনিয়ে আসছে, দেশে এলডিসি উত্তরণ নিয়ে বিতর্কও তীব্র হচ্ছে। সম্প্রতি ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে এই সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি, এই মুহূর্তে উত্তরণ হলে রফতানি খাতসহ দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপ, রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা, নির্বাচন ও জ্বালানি সংকট—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি চাপে পড়বে।

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ: ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এখনই উত্তরণ হলে দেশের তৈরি পোশাক খাত, ওষুধ শিল্প, সফটওয়্যার এবং কপিরাইটভিত্তিক অন্যান্য খাতে বড় প্রভাব পড়বে। শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে কাঁচামালের দাম বাড়বে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হ্রাস পাবে এবং বিদেশি বিনিয়োগের আগমন বাধাগ্রস্ত হবে। বিশেষভাবে ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন—এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব চুক্তিতে (ট্রিপস) অনেক ছাড় সুবিধা পাচ্ছে। সেই সুবিধা হারালে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে, বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান মনে করেন, এখনই উত্তরণ হলে—১. রফতানিতে প্রতিযোগিতা কমে যাবে, ২. শুল্ক বাড়বে প্রায় ১২ শতাংশ, ৩. রফতানি কমতে পারে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ, ৪. বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, ৫. জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলার সময় পাওয়া যাবে না।

সরকারের অবস্থান: বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, সরকার এলডিসি উত্তরণ তিন বছর পেছানোর জন্য কূটনৈতিকভাবে কাজ করছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন তিন বছর ডেফার করতে চেষ্টা করছে। তবে বন্ধুরাষ্ট্র জাপান ও তুরস্ক প্রায়শই বিরোধিতা করে। এবার তাদের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করছি।”

তিনি আরও জানান, সরকারের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই গ্র্যাজুয়েশন পেছানোর জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে তিনি খুব বেশি আশাবাদী নন। কারণ, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রেজ্যুলেশন পাস করতে বড় শক্তিগুলোর সমর্থন অপরিহার্য।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন মন্তব্য করেন, আগের সরকার রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে এলডিসি উত্তরণকে ব্যবহার করেছে, কিন্তু বাস্তব প্রস্তুতি নেয়নি। ফলে এখন সময়সীমা এক ধরনের চাপা বিস্ফোরণ বা “টাইম বোমা” হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের উচিত চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করা। না হলে ব্যবসায়ীরা সব সময় বলবে “প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি।”

 বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যাপিড আয়োজিত কর্মশালায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক উপস্থাপন করেন একটি গবেষণা প্রতিবেদন। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে আগামী এক বছরে বাংলাদেশের রফতানি ১৪ শতাংশ কমতে পারে। একইসঙ্গে প্রতিযোগী দেশগুলোর রফতানি—চীনের ৫৮ শতাংশ, ভারতের ৪৮ শতাংশ, ভিয়েতনামের ২৮ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ২৭ শতাংশও বড় ধাক্কা খেতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘এলডিসি উত্তরণে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার তিনটি সূচক বিবেচনা করা হয়। ইতিহাসে দেখা গেছে, যদি কোনও দেশ দ্বিতীয় পর্যালোচনায় এই সূচকে পিছিয়ে যায়, তখনই উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও তিনটি সূচকেই ভালো অবস্থায় রয়েছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অডিটের মাধ্যমে প্রমাণ দেখাতে হবে যে তিনটি সূচকের অন্তত দুটি উত্তরণের যোগ্যতার নিচে। অথবা প্রমাণ দেখাতে হবে—উত্তরণের পর দেশের অর্থনীতি আবার নির্ধারিত মানের নিচে নেমে যাবে।’’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “আট বছর সময় পাওয়ার পরও প্রস্তুত নয়—এটি যথেষ্ট যুক্তি নয়। এখন মনোযোগ দেওয়া উচিত মসৃণ উত্তরণ কৌশলে। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য, শ্রম উৎপাদনশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।”

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এলডিসি উত্তরণ পেছানোর নজিরও রয়েছে। মালদ্বীপে সুনামির ধাক্কা, নেপালে ভূমিকম্প, মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান এবং অ্যাঙ্গোলায় তেলের দামের পতনের কারণে উত্তরণ বিলম্বিত হয়েছে। সলোমন দ্বীপপুঞ্জও গৃহযুদ্ধের কারণে অতিরিক্ত সময় পেয়েছিল। তবে এসব ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল বড় ধরনের অপ্রত্যাশিত সংকট বা দুর্যোগ। বাংলাদেশকেও যদি সময় চাইতে হয়, বৈশ্বিক মঞ্চে শক্তিশালী যৌক্তিকতা দেখাতে হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এলডিসি তালিকায় প্রায় ৫০ বছর ছিল। এই সময়ে দেশ নানা বাণিজ্যিক সুবিধা, ঋণ ছাড় এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা পেয়েছে। এখন সেই মর্যাদা হারানোর প্রাক্কালে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। একদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রস্তুতির ঘাটতি মেটাতে সময় দরকার। অপরদিকে সরকার বলছে আর পেছানো যাবে না। অক্টোবর-নভেম্বরে সিডিপি মূল্যায়নের সময়ই শেষ সুযোগ আসবে। আবেদন করলে হয়তো কিছুটা সময় পাওয়া সম্ভব। না হলে ২০২৬ সালের নভেম্বরেই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠবে। প্রশ্ন রয়ে গেছে—বাংলাদেশ কি আরও কিছু সময় নিয়ে ঝুঁকি এড়াবে, নাকি নির্ধারিত পথে এগোবে? এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী দশকে দেশের অর্থনৈতিক পথ। উৎস: বাংলাট্রিবিউন।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়