লুৎফর রহমান রিটন: আধুনিক বাংলা গানের ঈশ্বর সলিল চৌধুরী ছোটদের জন্যেও নির্মাণ করেছিলেন কয়েকটি অনবদ্য গান। সলিল তার শিশুকন্যা অন্তরা চৌধুরীকে দিয়ে গাইয়েছিলেন গানগুলো। কী মিষ্টি কণ্ঠ ছিলো মেয়েটির! আশির দশকে ক্যাসেটের যুগ এলে অন্তরার একটা ক্যাসেট চলে এসেছিলো আমার হাতেও। সেই ক্যাসেটে আমার খুব পছন্দের ছিলো একটা গান‘এক যে ছিলো মাছি/ নাম ছিলো তার পাঁচি’। নদী যখন জন্মালো তখন সেই ক্যাসেটটা নিত্য বাজতো আমার ঘরে। অন্তরার সবক’টা গান নদীর ঠোঁটস্থ ছিলো। টোনাটুনির ক্যাসেট আর অন্তরার ক্যাসেট দুটি নদীর অসাম্প্রদায়িক মনোজগত নির্মাণে বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিলো। পাশাপাশি ডিজনির বই আর কার্টুনগুলো প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি পশু-পাখির প্রতি চিরস্থায়ী ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছিলো নদীর হৃদয়ে। বিশেষ করে পুজোর গানটা বাজতো যখন, সলিল চৌধুরীর অপরূপ মিউজিক কম্পোজিশনের ছন্দ-তালে নেচে ওঠতো নদী।
‘ও-ও -ও আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে। ঢ্যাম্ কুড়কুড়, ঢ্যাম্ কুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে। গাছে শিউলি ফুটেছে কালো ভোমরা জুটেছে। আজ পাল্লা দিয়ে আকাশে মেঘেরা ছুটেছে।’ আমাকে নাচ দেখাতে দেখাতে চিৎকার করে বলতো নদীবাবা পুজোর গন্ধ এসেছে বাবা। এখনো, পুজোর সময় আমি অটোয়ায় বসে একলা একা গানটা শুনি আর নদীর অনিন্দ্যসুন্দর ছেলেবেলাটাকে দেখি রিওয়াইন্ড ফরোয়ার্ড করে করে। এই যেমন এখন শুনছি। কারণ এই সময়টাই সেই সময় যখন বাতাসে পুজোর গন্ধ ভেসে বেড়ায়। করোনার থাবায় লভ হয়ে গিয়েছিলো আমাদের প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের সমস্ত অনুষঙ্গ। রীতিনীতি। উৎসব। আক্রান্ত হয়েছিলো ঈদ। আক্রান্ত হয়েছিলো পুজোও। সব কিছুই চলছিলো ভার্চুয়াল। অনলাইন। গেলোবারের মতো দুর্গা পুজো কী অনলাইনেই সারা হবে এবারো? মপ সাজবে না! বাজবে না ঢাকের বাদ্যি! স্বস্তির সংবাদ হচ্ছে মপ সাজবে। বাজবে ঢাকের বাদ্যিও। টেলিভিশনে কলকাতার পুজোর মার্কেটে দেখছি উপচেপড়া ভিড় মানুষের! (কিছুটা ভয়ও কিন্তু হচ্ছে।) [২] আমার শৈশব কেটেছে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। আমাদের বাড়িটাই ছিলো হেয়ার স্ট্রিটের শেষ বাড়ি। আমাদের বাড়ির পরের বাড়ি থেকেই হিন্দু বাড়ি শুরু। উত্তর মৈশুন্ডি আর দক্ষিণ মৈশুন্ডি ছিলো বলতে গেলে হিন্দু পাড়া। হিন্দুরা বনগ্রামেও ছিলো কিছু। প্রচুর হিন্দু বন্ধু ছিলো আমার। সমবয়সী সেই বন্ধুদের সঙ্গে কৈশোরে কতো আনন্দ করেছি পুজোর সময়।
বিশেষ করে দুর্গা পুজোর সময়টায়। সন্ধ্যায়, উত্তর মৈশুন্ডির মন্দিরের সামনের রাস্তায় দুর্দান্ত ঢাকের অপূর্ব ছন্দের দুর্ধর্ষ রিদমের জাদুতে পাগলপারা অবস্থা হতো আমার। আমার হিন্দু বন্ধুরা আমার হাতেও তুলে দিতো ধুপের ধোঁয়া ওঠা মাটির পাত্র, যেখানে থাকতো নারিকেলের ছোবড়ার মধ্যে সুগন্ধি আগুন। শুরু হতো আরতী নৃত্য। (ধুঞ্চি নাচ বলে সেটাকেই?) আমার বন্ধুরা, বন্ধুদের সমবয়সী বোনেরাও শামিল হতো আমার সঙ্গে। শামিল হতেন তাদের তরুণ বয়সী দিদি মাসি আর পিসিরাও। এই দিদি-মাসি আর পিসিরা যেন বা অপেক্ষায় থাকতেন কখন আসবে রিটন, মহল্লার ছন্দপাগল ছেলেটা! আমাকে দেখেই ‘তুমি আইছো রিটন?’ বলে মিষ্টি হাসিতে উদ্ভাসিত তারা কোমরে শাড়ির আঁচলটা গুঁজে নিয়ে নেমে পড়তেন সেই আলোর প্লাবনে, আরতী নৃত্যের অপরূপ জলসায় আমার সঙ্গে। মিউনিসিপ্যালিটির লাইটপোস্টের আলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়া মন্দিরের আলোকসজ্জা এবং সবক’টা হিন্দুবাড়ির বাড়তি আলোর সম্মিলনে রাস্তাটা ভাসতো আলোর বন্যায়। সেই ঝলমলে আলোর মধ্যে ধুপের রহস্যময় ধোঁয়ার কুলির ভেতর কতো যে নেচেছি আমি ঢাকিদের ঢাকের প্রবল উসকানিতে! বন্ধুদের মায়েরা মাসিরা দিদিরা আমার জন্য তুলে রাখতেন পুজোর মিষ্টি, বিশেষ করে লাড্ডু। আরতী নৃত্য শেষে আমাকে তারা নিয়ে যেতেন তাদের বাড়িতে। তারপর খেতে দিতেন আমার পছন্দের লাড্ডু। জীবনে বহু লাড্ডুই খেয়েছি দুনিয়ার বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে। কিন্তু দুর্গা পুজোর সেই লাড্ডুর হলদে আভা আর স্বর্গীয় স্বাদের সঙ্গে আর কোনো লাড্ডুর তুলনাই চলে না।
দূর প্রবাসে এই সময়টায় আমি আমার শৈশবের দুর্গা পুজোর সেই ঢাকের বাদ্যি, ধুপের ধোঁয়া, আরতী নৃত্য, ছেলেবেলার হিন্দু বন্ধুদের, বন্ধুদের বোনেদের, মা মাসি আর দিদিদের সর্বোপরি হলুদ কিংবা হালকা কমলা আভা ছড়ানো দুর্গা পুজোর লাড্ডুগুলোকে খুবই মিস করি। আহারে দুর্গা, আহারে লাড্ডু...। লাড্ডু-মপ-মহালয়া-বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে কলকাতার পূজা বার্ষিকীগুলো ছিলো আমার শৈশবের সবচে বর্ণাঢ্য আনন্দের প্রধানতম অনুষঙ্গ। বিশেষ করে আনন্দমেলার পূজা সংখ্যাটি হাতে পেলে আমি যেনবা পেয়ে যেতাম সাত রাজার ধন। তিন-চারদিন ধরে আমি শুধু আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকীর মেকআপ আর ইলাস্ট্রেশনগুলোই দেখতাম প্রাণ ভরে। তারপর পড়া শুরু করতাম। সত্যজিৎ-সুনীল-শীর্ষেন্দুর উপন্যাসগুলোই পড়া হতো আগে। আনন্দমেলার পাশাপাশি বহু কষ্টে সংগ্রহ করতাম পূজা সংখ্যা দেশ আর আনন্দলোক। কষ্ট করে সংগ্রহ করতাম মানে, তখন হাতে টাকাই থাকতো না। মোটা মোটা পূজা সংখ্যাগুলো কিনতে কিনতে আমি ফতুর হয়ে যেতাম। কারণ আমার শৈশব প্রাচুর্যপূর্ণ ছিলো না মোটেই। তখন ঢাকার ঈদ সংখ্যা আর কলকাতার পূজা সংখ্যাগুলো ছিলো মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাঙালির ধর্মীয় উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ। রচনাকাল/২৫ সেপ্টেম্বর [২০১৪] ঈষৎ সংক্ষেপিত। লেখক : ছড়াকার