মনজুরুল হক: আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমন্দির/আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি/অসীম ছন্দে বেজে ওঠে রূপ লোক ও রসলোকে আনেন ভাব মাধুরীর সঞ্জীবন/তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃতার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীকে আবাহন.../...বেজে উঠবে মহালয়ার আগমনী সুর...। শিউলীস্নাত স্নিগ্ধ হালকা কুয়াশা ভোরে হঠাৎই তিনবার বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনী! সেই সুর মিলিয়ে যেতেই শিউরে দেওয়া করুণ সুরে বেজে ওঠে সানাই...তারপর মৃদু ঢাকের বাড়ি...তারই ভেতর ধ্বনিত হয় ইয়া চ...শুরু হয়ে গেলো মহালয়া... দেবীপক্ষ! মহাসরস্বতী চিত্তে মহাল সদাত্মকে।/মহাকাল্যানন্দদরূপে তত্ত¡জ্ঞানসুসিদ্ধয়ে।/অণুসন্দধ্মহে চবয়ং ত্বাং হৃদয়াম্বুজে। অর্থাৎ মহাসরস্বতী চিদ্রপা, মহাল সদ্রƒপা এবং মহাকালী আনন্দরূপা। হে চকে, তত্ত¡জ্ঞান লাভের জন্য তোমাকে হৃদয়পদ্মে ধ্যান করি।
আর কয়েকশ বছর পর অত্যাধুনিক কসমিক মানুষের কাছে ধর্মগুলো অপাঙতেয় হয়ে ওঠবে। একসময় নেই হয়ে যাবে লোকাচার, দেশাচার আর সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গহীন ধর্মীয় রিচ্যুয়াল, আচার-অনুষ্ঠান। পূজা-পার্বনও অনাবশ্যক হয়ে পড়বে। থাকবে শুধু সাংস্কৃতিক উপাচার। বিপুল আয়োজনে দুর্গাপূজাও হবে না, কিন্তু মহালয়া থেকে যাবে তার ঐন্দ্রজালিক সুরের মূর্ছনায়। কারণ একমাত্র সুর-তাল-লয়-ই ভ‚তল-নভোমলে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। এসব নিরীখে আমার কাছে মহালয়ার সংগীতকে কোনো ধর্মীয় অনুষঙ্গ মনে হয় না। এ হলো মানুষের প্রাণশক্তি আর সৃজনশীলতার সুরেলা পরিভ্রমণ। অনন্ত শূন্যতায় সুরঝঙ্কার।
সিনিয়র দাদা এবং বন্ধু স্বরজিৎ বললেন, রাতে আগে আগে ঘুমাস। ভোর ৪টায় ওঠে রেডিও অন করিস। আকাশবাণী কলকাতা...দেরি করে ঘুমোনো অভ্যাস বলে আর ঘুমোলাম না। ঠিক ৪টায় রেডিও অন করলাম এবং কী এক ঘোরের মধ্যে কেটে গেলো দু’দুটো ঘণ্টা! এরপর বহু বছর কেটে গেছে। অডিও ক্যাসেটস, সিডি, লিংক, ডিভিডি হয়ে মহালয়া সেই যে টেনে রেখেছে... আর ছাড়েনি। পুজো আত্তির এসব জটিল ছুঁৎমার্গীয় নিয়ম-কানুনকে পাশ কাটিয়ে মহালয়া গেঁথে রয়েছে সংস্কৃতির মখমল চাদরের মতো জড়িয়ে! শিপ্রা বসু সুপ্রীতি ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, তরুণ বন্দোপাধ্যায় হয়ে হালের শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায় বা মধুরা ভট্টাচার্যসহ অসংখ্য কালজয়ী শিল্পীদের পরিবেশনা আর বাবু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’র চপাঠ শুনে মনে হয় এ যেন শুধুই সংগীত নয়, আরো বেশি কিছু। মহালয়া মানে বাঙালির আবাহনী। বাঙালির ঋতুবৈচিত্র্যের আবাহন। আশি^ন-কার্তিকের মঙ্গা, ঘরে ঘরে হাহাকারের মধ্যে মা দুর্গাকে ডেকে এনে কৃষককে সর্বস্বান্ত করা এর কালো দিক। যদিও দুর্গা মূলত অবস্থাসম্পন্ন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুজো।
এখানে ফাইফরমাশ খাটা ছাড়া দরিদ্র কৃষকের আর কিছু করার নেই। কৃষক-শ্রমিকের ‘নিজের’ বিশ্বকর্মা পুজো, সে তো অনেক আগেই চুপিসারে শেষ হয়। সেখানে মধ্যবিত্ত জ্যাত্যাভিমানী বাঙালির কোনো অংশগ্রহণ থাকে না বললেই চলে। আর আধুনিককালে শ্রমজীবী সনাতন বাঙালির পুজো বলতে কারখানার লোহার গেট (যেন বন্ধ না হয়)। কারখানার ভোঁ সাইরেন (যেন তাদের মহালয়া!) আর মধ্যবিত্ত রাজনীতিকের, শঠ-ঠগীদের নিত্য-নতুন কালাকানুনে জেরবার। তার পরও শরতের শিউলীগন্ধী ভোরে ভৈরবী রাগে এই মহালয়ার গান‘ওগো আমার আগমনী আলো’... কিংবা ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ মনটা কখনো বিরহী করে দেয়, কখনো উদ্বেল! নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করেছি এই সুর এতো হৃদয়মোচড়ানো কেন? উত্তর পাইনি। কেন তা মর্তলোক ছাপিয়ে অপার্থীব মনে হয়? উত্তর পাইনি! সানাইয়ের করুণ সুরটা কেন এমন খামচে ধরে? উত্তর জানি না। ফেসবুক থেকে