সিমু নাসের: গুলশানে কাজ ছিলো সকাল সাড়ে ১১টায়। বাসা থেকে সাড়ে ১০টায় রওনা দিয়ে জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে পৌঁছালাম বেলা ১টায়। কাজ ১ ঘণ্টার। এরপর ২টার দিকে জ্যামের ওপর অনেকটা রাগ করেই হেঁটে রওনা দিলাম ধানমন্ডির দিকে। হাতিরঝিল দিয়ে হাঁটবো নাকি লিংক রোড দিয়ে হাঁটবো-শুরুর এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই ছিলো সবচেয়ে জটিল। আক্ষরিক অর্থেই কয়েন টস করে লিংক রোড ভাগ্যে পড়লো। শুরু করলাম হাঁটা। উদভ্রান্তের মতো ছুটছে গাড়ি, মানুষ, রিকশা। সবারই এতো তাড়া। নিকেতনের গেটে এসে এক কাপ চা খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। একটু এগুতেই ব্র্যাক নার্সারি। একটা গাছ খুঁজলাম পেলাম না। আরোকিছু পছন্দের গাছ দেখলাম কিন্তু অযথাই এতো দাম। মনে হলো দামের জিনিসই যদি কিনতে হয় তাইলে আরও দামি জিনিস দেখি, ঢুকলাম বিএমডব্লিউর শোরুমে। নীল রংয়ের একটা এক্সওয়ান পছন্দ হলো। একদাম ৯২ লাখ টাকা। দেড় লাখের মতো রেজিস্ট্রেশন। বললাম ঠিক আছে, দেন। ক্যাশে টাকা দিতে যাবো তখন সেলসম্যান কম্পিউটার ঘেটে জানালো, স্যরি স্যার এই নীল রংয়ের এক্সওয়ানটাতো বিক্রি হয়ে গেছে, আপনি চাইলে সাদাটা নিতে পারেন। মনটা এতো খারাপ হলো, সাদা আর নীল কি এক হলো? ধুর কিনবোই না তাইলে, বলে বেড়িয়ে এলাম সেখান থেকে।
শরীরচর্চার দোকানগুলোয় ঢু মেরে বক্সিংয়ের জিনিপত্র খুঁজলাম কিছুক্ষণ। এই জিনিস চলে না বলে নাকি তারা এখানে রাখে না। হতাশায় এবার পেটটাও খাই খাই করছে। দ্য জাংশানে নাকি গ্যারাজ নামের একটা রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকলাম। মূলত ফুড কোর্ট। খাওয়ার অর্ডার করতে গিয়ে দেখা দুই পুরোনো কলিগের সঙ্গে। তারা খুব আদর করে বাকরখানি আর চা খাওয়ালো। শিখিয়েও দিলো কীভাবে চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে খেতে হবে বাকরখানি। আসলেই খুব মজা। আরও এক কাপ চা খেলাম সেখানে। নাবিস্কো, সাত রাস্তা হয়ে পৌঁছালাম কারওয়ানবাজার। এরমধ্যে রাস্তায় টেলিফোনের অসংখ্য তারের মধ্যে এক লোক ফাইবার অপটিকের তার কী জানি এক যন্ত্রে দিয়ে টেস্ট করছে। সেটা দেখলাম আধাঘণ্টা ধরে। কিছুই বুঝলাম না। হাতের ডানে/বামে তেজগাঁও ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালে কতো পুরোনো পুরোনো প্রতিষ্ঠান। গ্যাকো, পোলার আইসক্রিম, জিএসএস, বিজিপ্রেস। কারওয়ানবাজার থেকে আমার হাঁটার সঙ্গি হলো দীপ্র, পাভেল আর বাসার। রাস্তায় তখন এমনই কঠিন জ্যাম যে হাঁটা পর্যন্ত যায় না। বসুন্ধরা সিটির সামনেই এতো জিনিসের পসরা। ৫ জোড়া মুজা কিনলাম ফুটপাত থেকে। মাত্র ২০ টাকা জোড়া। অথচ একই মুজা ৫ জোড়া আমি সেদিন এক অনলাইন শপ থেকে সাড়ে ৫শ টাকা দিয়ে কিনলাম। অনেকদিন বসুন্ধরা সিটিতে যাওয়া হয় না। সেখানে আমার আর দিয়ার জন্য মোবাইলের লাল রঙের কাভার কিনলাম। ব্যাকআপ হিসেবে হলুদ, নীলও কিনলাম।
একটু হাটতেই দেখি পান্থপথের মোড়ে একটা অ্যাডভেঞ্চার শপ। সেটায় ঢুকে পঞ্চসহ আরও কী কী জানি কিনলাম। মাদল থেকে আবুল বাসার অদ্ভুত নামওয়ালা একটা সুগন্ধী চালের চিড়া কিনলো, তার দেখাদেখি আমিও কিনলাম। সঙ্গে দোকানদার খুব ভালো বলে খইসহ আরও কী কী জানি গছিয়ে দিলো। ইচ্ছে ছিলো দৃকের ছাদের রেস্টুরেন্টটায় একটু চা-কফি খাবো। কিন্তু আসতে আসতে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলা ট্রিবিউনের সামনে আরও কয়েকজন পুরোনো কলিগের সঙ্গে দেখা। আড্ডা দিলাম কিছুক্ষণ। রাসেল স্কয়ার পার হয়ে দেখি ৩২ নাম্বারের রাস্তাও বন্ধ। একটু সামনে দিয়ে বামে ঢুকে রাস্তার মাথায় গিয়ে দেখি পাইনউড নামের খুব সুন্দর গাছগাছালিওয়ালা একটা রেস্টুরেন্ট। কিন্তু ১০টা বেজে যাওয়ায় তারাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খাবারের আর অর্ডার নেবে না। লেকের পাড় দিয়ে সামনের একটা রাস্তা ধরে ২৭ নাম্বারে চলে এলাম। অলরেডি সাড়ে ১০টা বাজে। দীপ্রর ইচ্ছা টাউনহলে গিয়ে সিঙ্গাপুর জুস সেন্টারে গিয়ে জামের জুস খাবে। খুব নাকি ভালো। সেটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে ভেবে ২৭ নাম্বার পার হয়ে রিকশা নিলাম ৪ জন। না, জুস সেন্টার বন্ধ হয়নি। জামের সঙ্গে কতবেলের জুসও খেলাম। বেশ মজা। এরপরও আরও আড্ডা দিতে দিতে বাসায় ফিরলাম সাড়ে ১১টায়। কে বলেছে ঢাকায় হাঁটা যায় না।
গুলশান থেকে বাসায় আসতে আমার আজকে মোটে লাগলো ৯ ঘণ্টা। খরচ হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বিএমডব্লিউটা কিনে যদি গাড়ি করে বাসায় ফিরতাম তাহলে তো সাড়ে ৯৩ লাখের মতো খরচ হতো। হেঁটে আসায় খরচ কতো বাঁচলো চিন্তা করেন। উপসংহার [১] পৃথিবীর অনেক দেশের রাস্তায় আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেছি। কিন্তু ঢাকার মতো এতো ইন্টারেস্টিং ঘটনাবহুল রাস্তায় আমি আর কোথাও হাঁটিনি। জাস্ট কোনো একটা মোড়ের প্রত্যেকটা ঘটনা আলাদা আলাদা করে দেখতে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এতো বছর ঢাকায় থেকেও এই ঢাকা এতো অচেনা। চারদিকে ঘটনাবহুল সব গলি। বিশেষ করে দুপুরের ঢাকার গলির চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসলে পাশের বিল্ডিংয়ের অফিসে কী হচ্ছে, কার চাকরি থাকা উচিত না, কে বসকে তেল মেরে উপরে উঠে যাচ্ছে ইত্যাদি আপনার মুখস্ত হয়ে যাবে। উপসংহার [২] সত্যি সত্যিই আমাদের গন্তব্য সবসময় হাঁটা দূরত্বেরই, যদি তাড়া না থাকে। ফেসবুক থেকে