সুজন কৈরী : [২] রোববার বিকেলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের ডিসি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপ-কমিশনার আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার জুয়েল রানা একটি সিগারেট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন। তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা থাকতো। আর হঠাৎ করে টাকার প্রয়োজন হয় জুয়েলের পূর্ব পরিচিত একটি দুধ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি মিরাজের। কোনোভাবে প্রয়োজনীয় টাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় এক পর্যায়ে দুই সহযোগীকে নিয়ে জুয়েলকে হত্যা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে মিরাজ।
[৩] পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মিরাজ মো. রাসেল অপ্রাপ্তবয়স্ক আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে গাবতলীতে সিলভার রঙের একটি কাভার্ড ভ্যানে উঠে তিন দফায় ইয়াবা সেবন করেন। রাত ১০টার দিকে জুয়েলকে ডেকে কাভার্ড ভ্যানে উঠিয়ে ইয়াবা সেবন করান। এরপর সহযোগীদের নিয়ে কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে বসে পেছন থেকে রশি দিয়ে জুয়েলের গলাসহ নাক-মুখ পেঁচিয়ে ফেলে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মিরাজ পা-মুখ চেপে ও শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। পরে নিহত জুয়েলের কাছে থাকা সিগারেট কোম্পানির মালামাল বিক্রির ৭৬ হাজার টাকা ভাগ করে নেন মিরাজ ও তার দুই সহযোগী অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর ও হত্যার পরামর্শদাতা এবং পরিকল্পনাকারী রাসেল।
[৪] ডিসি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা প্রথমে ড্রাম কেনেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে গাবতলীতে জুয়েলকে আসতে বলেন। জুয়েল আসার পর তিনজন মিলে ইয়াবা সেবন করেন। তিন দফা ইয়াবা সেবনের এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন রাসেলও। তিনজন মিলে কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে বসে মিরাজকে হত্যা করেন। পরে নিহত জুয়েলের কাছে থাকা সিগারেট কোম্পানির মালামাল বিক্রির ৭৬ হাজার টাকা ভাগ করে নেন তারা।
[৫] ওই কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে থাকা ড্রামে জুয়েলের লাশ ঢুকিয়ে দুধ আর সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে দেন। এরপর পুরো মিরপুর ঘুরতে থাকেন নিরাপদে লাশ সরানোর জন্য। এ সময় মিরাজ তার কোম্পানির দুধও ডেলিভারি দেন। এক পর্যায়ে তারা মিরপুর সেকশন-১১ থেকে কাভার্ড ভ্যানসহ লাভ রোডের মুখে রাস্তার ওপরে জুয়েলের লাশভর্তি ড্রামটি ফেলে পালিয়ে যান। পরে স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যে ওইদিন দিবাগত রাত আনুমানিক দুইটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে অজ্ঞাত হিসেবে জুয়েলেরর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য তা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। কিন্তু মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও নিহতের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারছিলো না।
[৬] এক পর্যায়ে নিহতের গায়ে থাকা গেঞ্জিতে ‘সাফল্যের পথে একসাথে’ লেখা দেখে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, ওই সেøাগান সম্বলিত টি-শার্টটি একটি টোবাকো কোম্পানির। ওই কোম্পানির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও নিহতের ছবি দেখিয়ে জানা যায়, নিহতের নাম মো. জুয়েল রানা (২৯)। বাড়ি ভোলা সদরে। এরপর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবি দেখালে তারাও পরিচয় নিশ্চিত করেন।
[৭] নিহতের স্ত্রী সালমা আক্তার পুলিশের খবরে ঢাকা আসেন। পরদিন তিনি মিরপুর মডেল থানায় বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার এসআই খোকন মিয়া ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেন। জড়িতদের নাম-পরিচয় শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে অভিযান চালান।
[৮] এক পর্যায়ে শনিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দারুস সালামের গৈদারটেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনায় জড়িত ও তদন্তে শনাক্ত মিরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। মিরাজ রাজবাড়ীর কালুখালীর রওশন মন্ডলের ছেলে। অভিযানকালে তার কাছ থেকে নিহতের কাছ থেকে নেওয়া কোম্পানির সিগারেট বিক্রির নগদ ৩৮ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
[৯] উপ-কমিশনার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মিরাজের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে অভিযান চালিয়ে মিরপুর সেকশন-২ এর এফ ব্লকের ১ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাসা থেকে হত্যায় ব্যবহৃত সিলভার রঙের কাভার্ড ভ্যান, জুয়েল রানার ছবি সম্বলিত সিগারেট কোম্পানির আইডি কার্ড, চার কার্টন সিগারেট জব্দ করা হয়। পরে পল্লবী থানার সেকশন-১১ কাঁচা বাজার এলাকা থেকে হত্যায় জড়িত অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে সিগারেট বিক্রির নগদ ৭ হাজার টাকা ও ভিভো ব্র্যান্ডের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনসেট জব্দ করা হয়।
[১০] দুজনের দেওয়া তথ্যে একই এলাকা থেকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বরিশাল হিজলার কায়েসমা (রাঢ়ী বাড়ি) এলাকার আব্দুল সত্তারের ছেলে।
[১১] গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে মিরপুর বিভাগের ডিসি মাহতাব উদ্দিন বলেন, টাকার বিশেষ প্রয়োজন ছিলো মিরাজের। তিনি টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে রাসেলকে জানান। রাসেলের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় জুয়েল মিয়াকে হত্যার ছক কষেন তারা।
[১২] শুধু টাকার জন্যই জুয়েল হত্যার শিকার, নাকি মাদক নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব ছিলো- জানতে চাইলে সাংবাদিকদের বলে, সিগারেট কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করায় জুয়েলের কাছে বিক্রয় বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা মজুদ থাকতো, এটা জানতো মিরাজ। তিনজন মিলে ওই টাকা হাতিয়ে নিতেই হত্যার পরিকল্পনা করে। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও
আপনার মতামত লিখুন :