সুজন কৈরী: [২] মামলার তথ্য দাতা হিসেবে বাদিকে মূল অপরাধী হিসেবে সন্দেহ করা প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী। কারণ ভুক্তভোগীর পক্ষে বাদিকেই মামলা প্রমাণ করতে হয়। তাই বাদিকে দোষী প্রমাণ করতে যথেষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন মামলার তদন্তকারীদের। কিশোরগঞ্জে আপন বড় ভাইকে নৃশংসভাবে খুন করে মামলার বাদি ছোট ভাই। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে দোষী প্রমাণিত হন তিনি। গ্রেপ্তার করা হয় রিপনসহ ঘটনায় জড়িত ৪ জনকে।
[৩] পিবিআই জানায়, পারিবারিক, জমিজমা নিয়ে বিরোধ এবং নেশা করতে বাধা দেওয়ায় এসিড নিক্ষেপ ও পানিতে ডুবিয়ে ঘাড় ভেঙ্গে নৃশংস ভাবে বড় ভাই স্বপন মিয়াকে (৩৮) হত্যা করেন আপন ছোট ভাই রিপন মিয়া (৩৫)। পরে তিনি বাদি হয়ে ভাই হত্যার বিচার চেয়ে ভৈরব থানায় মামলা করেন। এজাহারে সন্দেহজনক ৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকেআসামি করা হয়।
[৪] তদন্তে পিবিআই জানতে পারে, নিহত স্বপন মিয়ার ৪ ভাই ও এক বোন। ভাইদের মধ্যে ভিকটিমের বড় ভাই খোকন মিয়া (৪০) সৌদি প্রবাসি। স্বপন স্থানীয় বাজারে চা বিক্রি করতেন। রিপন ছোট ভাই আগে মালয়েশিয়া প্রবাসি ছিলেন। ঘটনার ২ থেকে ৩ বছর আগে রিপন মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসেন। করোনার কারনে তিনি বিদেশে না যেতে পেরে বাড়ির পাশে মাছের খামারসহ কৃষি জমি আবাদ করতেন। নিহত স্বপনের সবার ছোট ভাই সোহেল মিয়া (৩১) একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। স্বপনকে হত্যার তিন দিন পর তার ছেলের জন্ম হয়। তাই তার স্ত্রী মামলার বাদি হতে পারেননি।
[৫] মামলা দায়েরের পর পিবিআই’র কিশোরগঞ্জের ক্রাইমসিন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পাশাপাশি ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তকালে পিবিআই’র কিশোরগঞ্জ জেলা ইউনিট প্রধান পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেনের কাছে মামলার বাদির আচরনে সন্দেহজনক মনে হয়। পিবিআই সিডিউলভূক্ত হওয়ায় গত ১ সেপ্টেম্বর মামলাটি অধিযাচন করে পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ সাখরুল হক খানকে তদন্তভার দেওয়া হয়। তদন্তকালে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মামলার বাদি রিপন, আব্দুর রব (৩৫), ইমান আলী (২৮) ও সবুজকে (৩৫) তাদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তারের রিপন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আপন বড় ভাই স্বপনকে হত্যার করেছেন বলে স্বীকারোক্তী দেন। পরে তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
[৬] পিবিআইর’র কিশোরগঞ্জ জেলা ইউনিটের ইনচার্জ পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, রিপন নিয়মিতভাবে তার পরিচিত কয়েকজন বন্ধুর সাথে মাদক সেবন করতেন। এছাড়া পারিবারিক বিভিন্ন কারণসহ পৈতৃক জমিজমার ভাগ নিয়ে বিরোধ ছিলো রিপনের। নেশা করতে স্বপন মিয়া রিপনকে বাধা দিতেন। নেশার বিষয়টি মাকে জানানোর কারণে বড় ভাইয়ের উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন ছোট ভাই রিপন। ভিকটিম বাড়ি থেকে নতুন রাস্তা নির্মানের খরচ আনুমানিক ১৫ হাজার টাকা না দেওয়ায় বড় ভাইয়ের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন রিপন।
[৭] এসব বিরোধে জেরে গত ২৫ জুলাই রাতে রিপনসহ তার পূর্ব পরিচিত আব্দুর রফ, ইমান আলী, সবুজ, বুলবুল আললম (আলকাছ) মিয়ার পুকুর পাড়ে বসে স্বপনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাদের মধ্যে বুলবুল চুরি, ডাকাতি, খুন কারবারির সঙ্গে জড়িত। পরিকল্পনা অনুযায়ী রিপনের দেওয়া ২০০টাকায় গত ২৬ জুলাই ইমান এবং বুলবুল ভৈরব বাজার বাইন্নাপট্টি থেকে এসিড কিনে রিপনের কাছে দেন। রিপন এসিডের বোতল তার বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে নিয়ে রাখেন।
[৮] ঘটনার সময় ব্যবহৃত ভিবারটেক ঠিক করার দায়িত্ব ইমান ও বুলবুলকে দেন। পরে ২৬ জুলাই রাতে এসিডের বোতলসহ রিপন, ইমান, সবুজ, বুলবুল, আব্দুর রব এবং ভিবারটেক ড্রাইভারকে নিয়ে তার গ্রামের লতিফ মাকের্টের ভিতরে অবস্থান নেন। ভিকটিম স্বপন মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে লতিফ মার্কেটের সামনে পৌঁছার পর আসামিরা তাকে ঘিরে ধরেন। বুলবুল ও সবুজ ভিকটিমকে পিছন থেকে গামছা দিয়ে নাকে মুখে পেঁচিয়ে ধরেন। ইমান ও আব্দুর রব স্বপনকে জোড় করে বিভারটেক গাড়িতে উঠিয়ে ফেলেন। পরে ছোট রাজাকাটা কবর স্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্বপন কৌশলে নিজেকে মুক্ত করে চলন্ত বিভারটেক থেকে লাফ দিয়ে দৌড় দেন। কিন্তু ইমান তার হাতে থাকা এসিডের বোতল স্বপনের নাকমুখ লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন। এসিড চোখ, মুখ ও নাকে লাগলে স্বপন বাঁচার জন্য জোরে চিৎকার দিতে দিতে দৌড়ে পাশে বিলের পানিতে লাফ দেন।
[৯] পানিতে লাফ দিয়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে আসামিরা বিলের পানিতে লাফ দিয়ে স্বপনকে ধরে ফেলেন। পানির নিচে চাপ দিয়ে ধরে রাখেন। ওই সময় আসামি রিপন, ইমান এবং আব্দুর রব ভিকটিমের হাত পা জোর করে ধরে রাখেন এবং আসামি বুলবুল এবং সবুজ ভিকটিমের মাথা ধরে জোর করে ঘাড় ভেঙ্গে ফেলেন। আসামিরা ভিকটিমকে পানিতে মাথা চেপে ধরে জোর করে ঘার ভেঙ্গে ফেলায় ভিকটিমের তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয়। পরে আসামিরা ভিবারটেকের অজ্ঞাত ড্রাইভারের সহযোগিতায় ভিকটিমের লাশ বিল থেকে উঠিয়ে ভিবারটেকে তোলেন। ঘটনাস্থল থেকে আসামিরা ভিকটিমের লাশ ৫০ থেকে ৬০ গজ দূরে নিয়ে একটি কালভাটের নিচে রেখে আসেন। আসামিরা যার যার মত করে পালিয়ে যান। রিপন ভিকটিমকে হত্যার পরিকল্পনার সময় আসামি সবুজকে ৫ হাজার টাকা দেন। এছাড়া পরিকল্পনার সময় রিপন ভিকটিম হত্যার অপারেশন সফল হলে প্রত্যেককে খুশি করে দেওয়ার কথা বলেন। গত ২৮ জুলাই স্বপনের লাশ কালবাটের কাছে পাওয়া যায়।
[১০] তিনি আরও বলেন, শনিবার কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর আদালতে আপন বড় ভাইকে হত্যার বিষয়ে নিজেসহ জড়িত আরও ৫ জনের নাম উল্লেখ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন রিপন। গ্রেপ্তার অপর ৩ জনকেও আদালতে পাঠিয়েছে পিবিআই।
আপনার মতামত লিখুন :