খসরু চৌধুরী : বন মোরগের ডাক না শুনলে সুন্দরবনের ভোর হয় না, সন্ধ্যা নামে না। এই মুরগির ডাক দেশের সব ধরনের জঙ্গলেই শোনা যেতো, এখন সম্ভবত আর শোনা যায় না। তবে সুন্দরবনে তারা এখনো আছে খুব বেশি না হলেও কিছু আছে। অনেকের ধারণা, সুন্দরবনের জেলে- বাওয়ালীরা যেসব মানতের মুরগি জঙ্গলে ছাড়ে তারা হয়তো তাদেরই বংশধর। সেটা ঠিক না। বনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম খুবই কঠোর, সামান্য এদিক ওদিক হলেই প্রাণ হারানোর বিপদ। ঘরের আদরে পোষা মোরগ মুরগি বনের জীবন মানানোর আগেই তারা অন্যের পেটে চলে যাবে। যারা বনের মুরগি দেখেছেন, তারা লক্ষ্য করেছেন বনের মোরগ-মুরগি দেখতে একই রকম। অথচ দেশি একই মুরগির ডিমে তোলা বাচ্চারা নানান রঙের হতে পারে। তাদের ডাক দেশি মুরগির ডাকের চেয়ে কিছু সুরেলা, তারা দেশি মোরগের চেয়ে সামান্য ছোট আর লম্বাটে। অনেক দেশি মুরগির সঙ্গেই তাদের চেহারার মিল পাবেন। আমরা পৃথিবীতে যতো ধরনের মুরগির ব্রিড তৈরি করেছে তার বীজের উৎস এই বনের মোরগ। ফলে একই ধরনের দেখতে দেশি মোরগের সঙ্গে এদের মিল খুব, শুধু বন্যের পায়ের রঙ কাল। আমরা যারা জঙ্গলে ছবি তুলতে যাই, তাদের কাছে বন মোরগের দেখা পাওয়াটাকে ভাগ্য মানি। কারণ মাইলের পর মাইল জঙ্গল পরিক্রমায় আপনি তাদের দেখা পাওয়া যায় না।
প্রখর দিনে তারা গাছের ওপরের ডালে ওঠে সময় কাটায়। নামে সন্ধ্যার দিকে। নামেই তারা ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতরে চলে যায়। পচা পাতা উন্টে পোকা মাকড় বের করে খায়। সুন্দরবনের কিছু কিছু চরাঞ্চলে উরি ধান নামের এক ধরনের নিকৃষ্ট ধান জন্মে। ধান পুষ্ট হলে বন মুরগীর ঝাঁক এসব চরে দিনের বেলা দেখা যায়। একবার একদল রাজশাহীর টুরিস্ট দলের সঙ্গে করেছিলাম। ট্যুর গাইড হঠাৎ সুদর্শন এক মোরগ দেখতে পেয়ে, সবাইকে বললেন, সবাই চুপ করুন, ওই যে বন মোরগ দেখুন। প্রথমে সবাই থমকে সেদিকে তাকালেন, কেউ কেউ ছবি তুললেন। একজন বলে উঠলেন, ‘আ রে মোরগের দেখছেন কী, উ তো সায়েব বাজারে হাজারে হাজারে দেইখছেন। এসব দেখতে কী সুন্দরবনে এসেছি? বাহাঘ কুণ্ঠে, বাহাগ দেখান বে’। সেদিন সন্ধ্যায় ছোট খাল বেয়ে ফিরছি।
আলো খুব কমে গেছে। ঘনায়নাম অন্ধকারে খালের ডান দিকের পাড়ে জঙ্গলের ভেতর মুরগির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ বা ধারে তাকিয়ে দেখে কেওরার কালো কালো শুলোর মধ্যে একটি বাহারী মোরাগ নেমে এসে খাল পাড়ের আয়োজন করছিলো। আমাদের দেখে থমকে গেছে। পর মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে উড়াল দিলো খাল পেরুতে। ক্যামেরা সেটিংস উড়তে থাকা কাউকে ধরার উপযোগী ছিলো না। তাও তাকে লক্ষ্য করে শাটার টিপ্লাম। মনের মতো না হলেও কিছু ছবি পাওয়া গেলো। বনে বনমোরগের বংশবৃদ্ধি খুব দ্রুত হয় না। তারা গাছের খোঁড়লে ডিম পাড়ে মোটে তিন/চারটে। বানর, সাপ, হাঁড়িচাচা, গুইসাপ তাদের ডিমে ভাগ বসায়। বড় মুরগি ফিসিং ক্যাট, লেপারড ক্যাট, বাঘের বাচ্চা, অজগরের শিকার হয়। বাওয়ালীরা মুরগি ধরার ফাদ তৈরি করতে জানে। এমনি এক বিষণ্ন আবহে টিকে আছে বনের সকাল সন্ধ্যার নকীব। ফেসবুক থেকে