অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন : ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, নগদ, আয়েশামার্ট, এহসান গ্রুপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছরে নিরীহ গোবেচারা বাঙালিকে বাঁশ দিলো আর সরকার চেয়ে চেয়ে দেখলো। ‘নগদ’ একদম ঢাকঢোল পিটিয়ে বললো- এটি ডাক বিভাগের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান। দেখা গেলো ডাক বিভাগ এর সঙ্গে কখনোই কোনোভাবে জড়িত নয় এবং ছিলো না। কিন্তু একদল মানুষ তাদের নাম ব্যবহার করে দিনের পর দিন ব্যবসা করে গেছে আর তারা চেয়ে চেয়ে দেখেছে। ক্ষমতাধর কেউ নগদের পেছনে না থাকলে এটা কি কল্পনা করা যায়? এখন শুনি এইটা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো প্রকার অনুমোদনই ছিলো না! নগদের পেছনের মানুষরা কতোটা ক্ষমতাবান হলে এতো কিছু দেখেও বাংলাদেশ ব্যাংক এতোদিন চোখ বন্ধ রেখেছিলো? প্রত্যেকটা কোম্পানি ই-কমার্সকে ব্যবহার করে বোকা জনগণকে একদম বলদ বানিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের পর রাষ্ট্র একটু নড়েচড়ে বসেছে। কিন্তু কাউকেই এই পর্যন্ত কোনো প্রকার শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এভাবে অবৈধ আয়ের টাকা অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নগদের বিরুদ্ধে একটি প্রত্রিকায় একটি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট হয়েছিলো।সেটি নাকি পরবর্তীতে পত্রিকা থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়।
বুঝতে পারছেন রাষ্ট্র এই অন্যায়ের কতোটা পৃষ্টপোষকতা করছে? এ জন্যই দেশের মানুষকে আমাদের সরকারেরা সঠিক মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায় না। আজকে যদি বাংলাদেশের মানুষ কোরিয়া, জাপান, ইউরোপ আমেরিকার মতো শিক্ষিত হতো এরকম ম্যাসিভ স্কেলে প্রতারণা করতে পারতো? মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিতের সংখ্যা কমছে বলে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদও হচ্ছে না। এভাবে আর কতো? তাহলে বোঝা গেছে সরকার কেন শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ায় না?
কেন গবেষণায় বরাদ্দ দেয় না? লেখাপড়ার অনেক উদ্দ্যেশ্যের মধ্যে একটি বড় উদ্দ্যেশ্য হলো সে যেন নিজ দেশের, নিজ সংস্কৃতির সাধারণ মানুষদের সঙ্গে ইন্টারেক্ট করতে পারে এবং বুঝতে পারে। আপনি দেখবেন শহরের উচ্চবিত্তের মানুষের বিশাল বড় একটা অংশ ইংরেজি মাধ্যম অথবা বাংলা মাধ্যমকে ইংরেজি বানিয়ে পড়ে ‘যাকে আমরা ভার্সন বলি’। যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন কোনো গান তারা শুনে। প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীর উত্তর হবে ইংরেজি গান এবং বড়জোর হিন্দি। তারা পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, বাউল, জারিগান, রবীন্দ্র সংগীত কিংবা নজরুলগীতি শুনেই না। তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন বাংলাভাষার ১০ জন সাহিত্যিকের নাম বলতে বড়জোর রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল আর খুব হলে একজনের নাম বলতে পারবে। তারা জানবে না সৈয়দ মুজতবা আলী কে, জানবে না শরৎচন্দ্র কে? মৈত্রী দেবী কে? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কে? জহির রায়হান কে? অথবা তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বলতে? আমার ধারণা পারবে না।
অর্থাৎ বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বড় হয়ে বাংলাদেশকে না চিনতে পারানোর দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের ভুল নীতির কারণে এই অবস্থা। তাদের মধ্যেই অনেকেই হয়তো কবি সাহিত্যিক নাট্যকার হতো। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কারণে বাংলাইতো ঠিক মতো বলতে পারেনা কবি সাহিত্যিক নাট্যকার হবে কীভাবে? আসলে গত ৪০ বছর যাবৎ যারা দেশকে চালিয়েছে তারা দেশকে নিয়ে সঠিক ভিশন নিয়ে ভাবেনি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবেনি। কল্পনা করা যায় যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করা দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবেই মানুষকে অর্থনীতিকভাবে বিভাজন করে শিক্ষার নানা মাধ্যম চালু করেছে। একেবারে অতিদরিদ্রদের জন্য কওমি মাদ্রাসা, নিম্নবিত্ত ও কিছু মধ্যবিত্তের জন্য মাদ্রাসা ও বাংলা মিডিয়াম, একটু এলিট মধ্যবিত্তের জন্য ভার্সন ও ইংরেজি মাধ্যম আর উচ্চবিত্তের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইংরেজি মাধ্যম। তাদের কারও সঙ্গে কারও ওভারল্যাপিং নাই। তারা প্রত্যেকেই একে অপরকে অপছন্দ করে। চাকরির ক্ষেত্রও আলাদা। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন করে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য ঢোকানো হয়েছে। বাংলা মাধ্যমকে পরিকল্পনা করে নষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে। নতুন যে সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে এর মাধ্যমে বাংলা মাধ্যম আরও খারাপ হবে এবং মানুষ ইংরেজি মাধ্যমে যেতে আরও বেশি করে বাধ্য করা হবে।
লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়