নির্মলেন্দু গুণ: ক্রিস্টাল ডায়ালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি (মুজিববর্ষের লোগো) দিয়ে বিশেষভাবে ফ্যাক্টরি থেকে তৈরি করা এই Most Cute ঘড়িটি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা একজন বিশেষ দূত মারফত আমাকে মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। এরকম সুন্দর একটা ঘড়ি ছিলো আমার কল্পনার অতীত। আমি ঘড়ি পরি না গত চল্লিশ বছরের বেশি হবে। অথচ এই আমিই কিনা মেট্রিক পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে হঠাৎ একদিন ঘোষণা করে দিয়েছিলাম যে, আমাকে একটা হাতঘড়ি কিনে না দিলে চলতি বছর [১৯৬২] আমার পক্ষে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এক কান দুই কান করে আমার কথাটা বাবার কানে পৌঁছলে বাবা প্রমাদ গুনলেন। তিনি তাঁর পুত্রটিকে চিনতেন। তিনি বুঝলেন- আলোচনার টেবিলে বিষয়টির সমাধান সম্ভব নয়।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় বাংলাদেশ যেমন স্বাধীন হয়েছে, ১৯৬২ সালে আমার ঘোষণাতেও তেমনি কাজ হয়েছিলো। আমার পুত্রস্নেহে অন্ধ পিতা, কিছু জমি বন্ধক রেখে আমাকে নিয়ে ময়মনসিংহ যান এবং ময়মনসিংহ শহরের গাঙ্গিনার পাড়ের ঘড়ির দোকান থেকে ১২০ টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট এ্যন্ড কিউট ক্যাভেলরী ঘড়ি কিনে দিতে বাধ্য হন। জানি আমার দাবি মানতে গিয়ে সেদিন আমার বাবার খুব কষ্টই হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি সেই কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন, যখন দুই বিষয়ে লেটার মার্ক নিয়ে আমি প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করি। তিনি নিশ্চিত জানতেন, ঘড়ি না কিনে দিলে, আমার এই ফললাভ কিছুতেই হতো না। এতো প্রিয় যে-ঘড়ি, সেই ঘড়িটি ১৯৬৮ সালে ঢাকা শহরের কোনো জুয়ার টেবিলে নিলামে বিক্রি হবে- এই কথা তখন কে জানতো? আমি বাবাকে সে-কথা কখনও বলিনি। বলবার মতো কথাও নয়। যাক সে কথা। এই একটা ঘড়িই আমি জীবনে কিনেছিলাম। বিদেশ থেকে প্রচুর ঘড়ি আমি কিনে এনেছি আমার ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব ও বিশেষ বিশেষ বান্ধবীদের জন্য। কিন্তু নিজের জন্য ঘড়ি? ভুলে যান। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করার কারণে আমি বেশকিছু ঘড়ি উপহার হিসেবে পেয়েছি। ওই ঘড়িগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি ঘড়ি কাউকে-কাউকে উপহার দিয়েছি।
কয়েকটি দামী ব্রান্ডের ঘড়ি কাশবন ও কবিতাকুঞ্জের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। ইচ্ছে করলেই পরতে পারি, কিন্তু পরি না। সময়কে প্রত্যক্ষ করার চাপ আমি সইতে পারি না। আনস্মার্ট মনে হয় নিজেকে। কিন্তু, গতকাল উপহার হিসেবে যে ঘড়িটি পেয়েছি- এই ঘড়িটি কেন যেন কিছুতেই আমার হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না। ঘড়িটি আমার সংগ্রহশালায় রাখার ওপরও ভরসা পাচ্ছি না। যে-বাঙালি শান্তনিকেতনের সুরক্ষাবলয় ভেদ করে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের স্বর্ণপদক চুরি করতে পারে, তাদের বংশধরদের কথা আমার বিবেচনায় রাখা দরকার বৈকি। বাংলাদেশে চোর-ডাকাতরা যে এখনও নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে বসেনি, এটাই কি যথেষ্ট নয়? জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। মহান স্রষ্টার কাছে জাতির পিতার বিদুষী কন্যাদ্বয়ের জন্য সুস্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা প্রার্থনা করছি। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১। ফেসবুক থেকে