নিউজ ডেস্ক: রাজশাহীর দুর্গাপুরের আঙ্করার বিল। কয়েক বছর আগেও বিলের কিছু জমিতে বছরে দুইবার ধান চাষ করা হতো, কিছু জমিতে একবার। বিলের উঁচু অংশে করা হতো সবজি চাষ। এতে তেমন লাভের মুখ দেখতেন না কৃষকরা। কিন্তু সেখানে এখন মাছের চাষ করে ভাগ্য ফিরেছে তাঁদের। পাশাপাশি স্বাবলম্বী হয়েছে যুবসমাজের বড় একটা অংশ। কালের কণ্ঠ
গত কয়েক বছরে শখানেক পুকুর গড়ে উঠেছে আঙ্করার বিলে। এসব পুকুরে চাষ করা হচ্ছে রুই, কাতল, মৃগেল, কালবাউশ, সিলভার কার্প, ব্লাড কার্প, গ্রাস কার্প, ট্যাংরা, পাবদাসহ নানা জাতের মাছ। বেশির ভাগ মাছ চাষি ৮ থেকে ১০ বছরের জন্য জমি বর্গা নিয়ে পুকুর কেটেছেন। এতে তাঁদের দিন বদলে গেছে। আর জমি বর্গা দিয়ে ফসল চাষের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়তি টাকা পাচ্ছেন জমির মালিকরা।
শুধু আঙ্করার বিলেই নয়, উপজেলার উজান খলিস, জুগিশো, পালশা, রাতুগ্রাম, পুরান তাহেরপুর, কয়ামাজমপুর, গোপালপুর, শ্যামপুর, তেঘোর, আমগাছী, চৌপুখরিয়াসহ বেশির ভাগ বিলেই গত কয়েক বছরে হাজার হাজার পুকুর কাটা হয়েছে। একইভাব জেলার বাগমারা, মোহনপুর, পবা, তানোর, গোদাগাড়ী, বাঘা-চারঘাট এবং পুঠিয়ার বিভিন্ন বিলেও এখন অসংখ্য পুকুর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এসব পুকুর থেকে তাজা মাছ ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে কৃষিজমি হারালেও মাছ চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন ব্যবসায়ীরা। লাভবান জমির মালিকও। যদিও বেশি লাভের আশায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পুকুর কাটার অভিযোগ আছে। অনেক ক্ষেত্রে তিন ফসলি জমি কেটে পুকুর করা হয়েছে। ফলে কমছে কৃষিজমি। এমনকি আমের বাগানকেও পুকুরে রূপান্তর করার নজির আছে।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে রাজশাহীর ৯ উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭২০। ১০ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। সূত্র মতে, জেলায় এখন ১৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে পুকুর রয়েছে, যেখান থেকে বছরে ৮৩ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে রাজশাহীর চাহিদা ৫২ হাজার ৫৬৩ মেট্রিক টন। বাকি মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। এতে বছরে প্রায় এক হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা আয় হচ্ছে (গড়ে কেজিপ্রতি ২০০ টাকা ধরে)।
তবে মাছ চাষিরা বলছেন, জমি বর্গা দিয়ে বসে থেকে বছর শেষে বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে পকেটে তুলছেন জমির মালিকরা। পাঁচ থেকে আট বছর আগেও জমি বর্গা নিতে বছরে ১০ হাজার টাকা দিলেই হতো, এখন ৬০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে তাঁদের লাভ ততটা নয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক পুকুরের পারে আম, কলা, পেয়ারা, পেঁপে, লেবুসহ নানা ধরনের ফল ও সবজিও চাষ করা হচ্ছে। ফলে আসছে বাড়তি অর্থও। মাছ চাষি ও জমির মালিকরা জানান, শুধু মাছ চাষ করেই কোটিপতি বনে গেছেন, এমন চাষির সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হয়েছেন।
দুর্গাপুরের মাছ চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তেমন লাভ হচ্ছে না। কিন্তু ফসল চাষ করতে গেলে একবার লাভ হয় তো তিন-চার বছর লোকসান গুনতে হয়। ধানের যে উৎপাদন খরচ হয়, সেটিও অনেক সময় ওঠে না। ফলে জমি বর্গা দিয়ে এখন কৃষকরা তার চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি ধান বা চাল কিনতে পারেন, যা জমিতে করে সম্ভব হয় না।’ এ কারণে দিনের পর দিন পুকুরের সংখ্যা বাড়ছে এবং ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি।
দেদার পুকুর কাটার ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে থানা পুলিশ প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করার অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কৃষক জানান, এ নিয়ে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হওয়ার খবর বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। অবাধে পুকুর কাটা রোধে উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় স্যানাল বলেন, লাগামহীনভাবে বিলের ফসলি জমি কেটে পুকুর খনন করায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, যা বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। এ ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া পুকুর খনন করা যাবে না বলে মত দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুকুর কাটা রোধে স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেল-জরিমানাও করেছেন। দুর্গাপুরের জয়নগর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজুল করিমকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। তবে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। প্রতিবছর বর্ষা শেষেই পুকুর কাটার হিড়িক পড়ে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কে জে এম আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘জেলায় গত কয়েক বছরে পুকুরের কারণে অনেক ধানি জমি কমেছে। তবে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরেও পুকুরগুলো কিভাবে গড়ে উঠেছে, সেটি বলতে পারব না।’ জেলায় গত কয়েক বছরে মোট কী পরিমাণ ফসলি জমি পুকুরের কারণে নষ্ট হয়েছে, তা-ও জানাতে পারেননি তিনি।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলোক কুমার সাহা বলেন, ‘গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে প্রায় দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন বেড়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে পুকুরও বেড়েছে দু-তিন গুণ। মাছ চাষ করে অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের জন্য চাষিদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে জেলায় মাছ এখন উদ্বৃত্ত থাকছে। যা দেশের বিভিন্ন জেলা এবং দেশের বাইরে রপ্তানি করে বিপুল অর্থ আয় হচ্ছে।’