গৌতম রায়: আমার এই স্ট্যাটাসটি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক পছন্দ করবেন না; কিন্তু যেহেতু আমার স্ট্যাটাসের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না, সেই হিসেবে যারা পছন্দ করবেন না, তাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেই পরীক্ষা নেওয়া হবে- এমন কথাবার্তা চলছে বেশ। কিন্তু আমার মনে হয়, এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। যাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছিলো কিন্তু শেষ হয়নি, শুধু তাদের পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া যাদের অনলাইনে কোর্স শেষ হয়েছে, তাদের পরীক্ষা নেওয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না। শিক্ষা বা লেখাপড়া শুধু পরীক্ষা বা সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ নয়; লেখাপড়া একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার একটা আপাত-সমাপ্তি ঘটে পরীক্ষার মাধ্যমে। অনলাইনে আমি ইতোমধ্যে কয়েকটি কোর্স করিয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা এবং আরও কয়েকজনের অভিজ্ঞতা জানার ভিত্তিতে অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, অনলাইন এখনও অফলাইনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি, অন্তত আমাদের দেশে। এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো শিক্ষার্থীদের বুঝাতে গিয়ে আমি রীতিমতো হিমশিম খেয়েছি; শিক্ষার্থীরাও তাদের মতো করে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তারাও আত্মস্থ করতে গলদঘর্ম হয়েছেন। জুম একটি কনফারেন্সিং টুল, কোনো এলএমএস নয়। জুমের হোয়াইট বোর্ড আর আইইআর ২০৬-এ রুমের হোয়াইট বোর্ড এক নয়। কিংবা এক হলেও দুই বোর্ডের পার্থক্য আমি ঘুচাতে পারিনি, এটা স্বীকার করতে হবে আমাকে।
এগুলোর বাইরেও একটি দীর্ঘ বিরতির পর শিক্ষার্থীদের ধাতস্থ হওয়ার বিষয় রয়েছে। রয়েছে হল লাইফ, দৈনন্দিন আড্ডা, সেমিনার লাইব্রেরি ব্যবহার, গ্রুপ স্টাডি ইত্যাদি নানা বিষয়ের পরস্পরের সাথে সিনক্রোনাইজেশনের বিষয়। আপতদৃষ্টিতে এগুলোকে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে, কিন্তু যেখানে দীর্ঘ বিমানযাত্রার পর নিজেকে ঠিক করতে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকের কয়েকটা দিন চলে যায়, সেখানে বছর দেড়েক বিরতির পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলেই পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থী এক পর্যায়ে নিজেই আবিষ্কার করবে যে, এই ধরনের পরীক্ষা আদতে তার ক্ষতি করছে। স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থী যে ধরনের পারফর্ম করতে পারতেন, দীর্ঘ বিরতির পর কলম ধরাটাই তার জন্য কষ্টকর হতে পারে। আগ্রহের বশে কিংবা দীর্ঘ ক্ষতি পোষানোর প্রচেষ্টা হিসেবে অনেকেই হয়তো দ্রুত পরীক্ষায় বসতে চাইবেন, কিন্তু তার পূর্বে বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে বিস্তর। আমি মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যতো দ্রুত সম্ভব খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে একটি মাস সময় দেওয়া প্রয়োজন নিজেকে কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। শিক্ষকদের জন্যও এটা প্রয়োজন। এই সময়ে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন তাদের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করবেন, অপরদিকে লেখাপড়ার কগনিটিভ ঘাটতিগুলোও দূর করার প্রয়াস গ্রহণ করতে পারবেন। একটু সুস্থ-পরীক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এটি খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি। পরীক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় শিক্ষার্থী কী জানেন সেটি যাচাই করা, তাহলে এসব বিষয় নিয়ে অবশ্যই ভাবা প্রয়োজন। আর উল্টোটা হলে, অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে ঠেকিয়ে দেওয়া বা শিক্ষার্থীরা কী জানেন না সেটিকে ফোকাস করা, তাহলে হল খোলার পরদিনই পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।
এই লেখার পুরোটাই নিজস্ব উপলব্ধি থেকে, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা-বিষয়ে যৎসামান্য জানাশোনার ওপর ভিত্তি করে। সেজন্যই বারবার ‘আমি মনে করি’ বা ‘আমার মনে হয়’ এ-ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছি। এই আশঙ্কা সত্যি হতে পারে, না-ও পারে। দুর্ভাগ্য এটুকুই যে, এ-ধরনের সিদ্ধান্তগ্রহণের আগে যে-ধরনের গবেষণা করা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেরকম গবেষণা হয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারতো এ-ধরনের বিষয় নিয়ে যারা কাজ করেছেন এমন শিক্ষকদের টিম তৈরি করে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সম্ভাব্য নেতিবাচক দিক এড়ানো সম্ভব সেরকম বিষয়ে গবেষণা করতে। আমার এই লেখা পড়ে আমাকে পরীক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন নেই, আমি শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে এবং এসবের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে প্রায়ই সন্দেহ প্রকাশ করি। এই লেখাসেই আশঙ্কারই প্রতিফলন মাত্র। ফেসবুক থেকে