মাসুদ রানা: এ্যামেরিকার উস্কানিতে ও সহযোগিতার আশ্বাসে রাশিয়ার ও চীনের যে-প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো তাদের বিরুদ্ধে সামরিকভাবে দাঁড়াবার চিন্তায় বিভোর ছিলো, তারা এখন সাংঘাতিকভাবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তারা আফগানিস্তানে এ্যামেরিকার লেজে-গোবরে অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আস্থা হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে। বিশ্ব লক্ষ করছে যে, এ্যামেরিকা সংঘাতের শুরুতে তাদের সহযোগীদের প্রতি সাহায্য, সহায়তা ও প্রতিরক্ষার আশ্বাস দিলেও, পরাজয়-কালে সব ভুলে, সহযোগীদের ফেলে 'চাচা আপ্না জান বাঁচা' প্রকারের পিঠটান দেয়। এটি কোরিয়াতে হয়েছে, ভিয়েতনামে হয়েছে, সিরিয়াতে হয়েছে এবং সর্বশেষ আফগানিস্তানে হয়েছে।
ইউরোপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন এবং এশিয়াতে চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ান এ্যামেরিকার ওপর ভরসা করে যে-দাঁড়ানোর চিন্তা করছিলো, সেখানে সাংঘাতিকভাব হতাশ হয়ে পড়েছে তারা। হতাশ ইউক্রেন সর্বশেষ বলেছে, এই মুহূর্তে চীনই হচ্ছে তাদের বড়ো বন্ধু।
আফগানিস্তানে এ্যামেরিকার বিপর্যয় ভারতের জন্যেও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সম্ভবতঃ ভাবতে শুরু করেছে যে, চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্যে এ্যামেরিকার ওপর ভরসা করাটা ঠিক হবে কি-না।
এ্যামেরিকাকে মডেল ধরে ভারত যে তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদেরকে সাবমিশনে বাধ্য করে চীনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলো হিন্দু জাতীয়তাবাদী জোশে, আফগানিস্তানে এ্যামেরিকার শোচনীয় পরাজয় ও প্রস্থানের প্রেক্ষেপটে তাদের সে-স্বপ্নে জাগরণের ধাক্কা লেগেছে। ইতিহাস পড়ে আমরা জানি যে, অষ্টম দশকে আরবদের সিন্ধু অভিযান ও দখল তেমন কোনো অভিঘাতই সৃষ্টি করতে পারেনি হিন্দু-ভারতে, কিন্তু দশম শতকে আফগানিস্তানের গজনা বা গজনি থেকে সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের পথ ধরেই সেখানে শেষপর্যন্ত মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৮৫৭ পর্যন্ত টিকে ছিলো।
আফগানিস্তান থেকে ভারত দখল করার ইতিহাসটি ভারতে উচিত না-ভোলা। পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে গর্বিত ও নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। মাও সেতুংকে উদ্ধৃত করে বলতে হয়ঃ যুদ্ধে যা লড়ে, তা অস্ত্র নয়; লড়ে মানুষের মন। যুদ্ধে যে মানুষের মনই লড়ে এবং জয়ী হয়, তা আমরা ইতিহাসে যুগে-যুগে দেখেছি। পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার পরও এ্যামেরিকা কোরিয়ার যুদ্ধে হেরেছে; ভিয়েতনাম যুদ্ধে হেরেছে; সিরিয়া থেকে প্রস্থান করতে বাধ্য হয়েছে এবং সর্বশেষ আফগানিস্তানে হেরেছে।
ভারতের উচিত হিন্দুত্ববাদী জাতীয়বাদ পরিত্যাগ করে একটি ধর্মনিরেপক্ষ ফেডারালিজমের দিকে যাওয়া এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি অধীনতামূলক বন্ধুত্বের অভিনয় ছেড়ে সমতার ভিত্তিতে প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। ধর্মকে আশ্রয় করে ভারতীয় রাজনীতি এই উপমহাদেশকে হয়তো ভিন্ন আঙ্গিকে দশম শতকের 'ভালনারিবিলিটি'তে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পার। ২৫/০৮/২০২১। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড।