অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): আগস্টের কিছু-কিছু তারিখে যখন আমাদের উৎসবে মাতার কথা ছিলো, তখন উল্টো ১৫-কে সামনে রেখে প্রচণ্ড ব্যথায় শোকে নীল সেই তারিখগুলো। মাসের এমনি প্রথম তারিখটা আগস্টের ৫, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের জন্মদিন। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে ক্ষণজন্মা মানুষগুলোকে ইতিহাসে ঘায়েল করার জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যয় করে ঐতিহাসিকভাবে জাতির সামনে হেয়-প্রতিপন্ন করার প্রয়াস আমরা দেখি তাদের তালিকার একেবারে ওপর দিকে শেখ কামালের নামটি। একের পর এক অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তার নামটি জুড়ে দিয়ে শেখ কামালকে এমন অন্যায় ব্র্যান্ডিংয়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশ তো বটেই, আমাদের এই অঞ্চলেও নজিরবিহীন। আমরা যারা নব্বই দশকের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম, তাদের স্বপ্নেও কোনোদিন ছিল না যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ টানা একযুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকবে। বরং আওয়ামী লীগ যুগের পর যুগ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে যোজন-যোজন দূরে থাকার অমোঘ নিয়তিকে মেনে নিয়েই সেই সময়কার তরুণরা শুধু আবেগ, আদর্শ আর ভালোবাসার জায়গা থেকে ‘শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির’ মূলমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ছাত্রলীগের মিছিলে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান ধরতো। সেই তরুণরাই পরবর্তী সময়ে হাল ধরেছে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের আর সাথে এর নানা অঙ্গ আর সহযোগী সংগঠনের। আমাদের আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও তো এই ছাত্রলীগেরই সোনালী অর্জন।
এখন মধ্য বয়স্ক এই আমি যখন আমার যৌবনে ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে পেছন ফিরে তাকাই, তখন মাঝে মাঝেই এই ভেবে অবাক হই যে এমন একটি ছাত্র সংগঠন এত দমন-পীড়ন আর প্রতিকূলতার মুখেও কীভাবে শুধু টিকেই থাকেনি, বরং নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ সৃষ্টির পথে প্রতিটি বড় আন্দোলনে আর স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন ঝঞ্জা-বিক্ষুদ্ধ সময়ে দেশ আর দেশের মানুষের পাশে থেকেছে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আর অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে। আমার উপলব্ধি ছাত্রলীগ তার সংগ্রাম আর বিকাশের একেকটি পর্যায়ে এমন কিছু অসম্ভব মেধাবী সংগঠকের ছোয়া পেয়েছে যাদের অনুপস্থিতিওে তাদের সেই সোনালী ছোয়ার অনুরনন রয়ে গেছে বহুযুগ ধরে। তাদের মধ্যে যে নামটি সবচাইতে জ্বলজ্বলে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার হাতে গড়া এই ছাত্রলীগ। একইভাবে আরেকটি উজ্বল নক্ষত্র শেখ কামাল, একজন অসম্ভব গুণী সংগঠক, যিনি ছাত্র রাজনীতির জন্য নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন, আর বিশাল কোনো পদধারী না হয়েও হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রলীগের মূল চালিকাশক্তি।
অসম্ভব মেধাবী এই সংগঠক নানানভাবে তরুণদের সংগঠিত করে এদেশের তরুণদের সামনের দিগন্তটাকে আদিগন্ত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন। তিনি একাধারে যেমন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মতন স্পোর্টস ক্লাবের স্বপ্নদ্রষ্টা, তেমনি ঢাকার সে সময়কার ঐতিহ্যবাহী ইস্টএন্ড আর কামাল স্পোর্টিং ক্লাবও তার সাংগঠনিক ছোয়ায় বিকশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মেশিনে তৈরি আধুনিক ফুটবল, আধুনিক জার্সি আর স্পোর্টস স্যু পড়ে আধুনিক ফুটবলের সূচনা আবাহনীর মাধ্যমে শেখ কামালের হাত ধরেই। আবার এই শেখ কামালই ইস্টএন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের মাধ্যমে পুরান ঢাকার তরুণ আর প্রভাবশালীদের আকৃষ্ট করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক আদর্শের প্রতি। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা জেলা পরিষদের অডিটোরিয়ামে প্রথম মঞ্চ নাটকের মঞ্চায়নের পেছনেও শেখ কামাল। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া অডিটরিয়ামটিকে পরিষ্কার করে এক রাতের মধ্যে নাটক মঞ্চায়নের জন্য প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে প্রথম মঞ্চ নাটকটির মঞ্চায়নের মতো একই সাথে সাংগঠনিক দক্ষতা আর দুরদৃষ্টির অদ্ভুত সমন্বয় ছিলেন একজন শেখ কামাল। আবার তিনি যেমন একদিকে বিটিভিতে প্রথম সিরিজ নাটকের উদ্যোক্তা এবং অভিনয় শিল্পী, তেমনি অন্যদিক তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু এদেশের প্রথম ব্যান্ড সঙ্গীত দলটিরও।
এই লেখাটি এ পর্যন্ত পড়ে যদি কেউ ধারণা করেন যে শেখ কামাল শুধু রাজনীতি আর স্পোর্টস, সাথে শিল্প-সংস্কৃতির জগতেই তার প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছিলেন। তবে তাদের জানতে হবে যে এই অকুতোভয় তরুণটিই ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমিশনপ্রাপ্ত একজন চৌকষ সেনা কর্মকর্তা। ভারতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের তরুণ অফিসারদের প্রশিক্ষণকালীন সময়ে তিনি ছিলেন এককথায় মধ্যমণি। সারাদিন কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে অফিসার্স মেসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে দেশাত্ববোধক গান গেয়ে সহকর্মীদের মাতিয়ে-তাতিয়ে রাখতেন শেখ কামাল আর যেদিন কমিশন পেলেন, সবাই দেখলো মেধাবী এই তরুণটির স্থান মেধাক্রমে পঞ্চম। স্বাধীন বাংলাদেশেও সেনাবাহিনীতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যমণি ছিলেন শেখ কামাল। অথচ তিনিই অবলীলায় সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ফিরে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। লক্ষ্য ছিল ছাত্রলীগটাকে সংগঠিত করা। মাঝে মাঝেই ভাবি যদি শেখ কামাল সেদিন সেই সিদ্ধান্তটি না নিতেন, তাহলে হয়তো ১৫ আগস্ট সংগঠিত হতো না। কারণ তার উপস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে এমন চক্রান্ত করার সাহস প্রথমত কেউ দেখাতো না, আর দেখালেও বিষয়টি কখনোই তার অজ্ঞাতে থাকতো না।
আজ যখন করোনাকালে জর্জরিত গোটা পৃথিবী, তখন বাংলাদেশ মন্দ দেখাচ্ছে না। আর দুদিন পরেই ভ্যাকসিন যাচ্ছে গ্রামে। পৃথিবীর শতাধিক দেশে যখন ভ্যাকসিন এখনো সোনার হরিন, সেখানে জননেত্রী শেখ হাসিনার একক কৃতিত্বে, নিজেরা ভ্যাকসিন উৎপাদন না করেও, বাংলাদেশ এখন গ্রাম পর্যায়ে গণভ্যাকসিনেশন শুরু করতে যাচ্ছে। তাও আবার এমন সব ভ্যাকসিন নিয়ে যার একটা বড় অংশই উপহার হিসেবে পাওয়া আর যাওবা কেনা, তাও কেনা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের চেয়েই অনেক কম দামে। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ ভ্যাকসিনগুলোর সুষ্ঠু বিতরণ, শুধু প্রশাসন আর সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য অবকাঠামো ব্যবহার করে যা নিশ্চিত করা অসম্ভব। এ কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মাঠ পর্যায়ের প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের এই মহা-ভ্যাকসিন যজ্ঞে সম্পৃক্ত করার। আজকের এই দিনটিতে শেখ কামালের বেদনায় নীল আরও একটি জন্মদিনে এই স্বপ্নচারী ছাত্রসংগঠককে জাতির বড় বেশি প্রয়োজন ছিলো। আজ যদি তিনি তার প্রিয় বড় বোনের পাশে থাকতেন, আমি নিশ্চিত তার স্বপ্নালু সাংগঠনিক দক্ষতায় কোভিডকে হারিয়ে দেয়ার এই যুদ্ধে আমরা আরো অনেক বেশি এগিয়ে থাকতাম। তারপরও আশা ছাড়ছিনা। শেখ কামাল নেই কিন্তু তার আদর্শে অনুপ্রাণিত তার অনুজরাই তো সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে এই ভ্যাকসিনযজ্ঞটিকে সফল করায় মাঠে থাকবেন।
লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।