স্বপ্না রেজা: না, ঘটনা সত্য নয়। মানুষ তার কৃতকর্মের ফল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু প্রসবের মাধ্যমে ভোগ করেন না। বিশেষ শিশু প্রসব বাবা-মায়ের কৃতকর্মের ফল- এমন ধারণাপোষন বিশেষ শিশুর মানবমর্যাদা ভুলন্ঠিত করে, সাংবিধানকি অধিকার লংঘণ করে এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর চরম বিরোধিতা করে। এমন ধারণা পোষন সমাজের জন্য ক্ষতিকর। আর যিনি বা যারা এমন ধারণা পোষণ করেন তারা নিঃসন্দেহে সমাজবিরোধী।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি নাটক ‘ঘটনা সত্য’ নিয়ে তুমুল অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানবসন্তান প্রসবকে কেন্দ্র করে নাটকে নাট্যকার যে তথ্য তুলে ধরেছেন, সেটাই তীব্র অসন্তোষের মূল কারণ। যা বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের মানবমর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করেছে এবং যা তার সাংবিধানিক অধিকার ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর চরম বিরোধিতা করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নাটকের প্রতি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সন্তানের অভিভাবক, স্বজন-প্রিয়জন, সংগঠন ও প্রতিবন্ধীবান্ধব ব্যক্তিদের তীব্র প্রতিবাদ লক্ষ্য করে নাটকটি দেখলাম ইউটিউবের সিএমভিতে (সম্ভবত)। হতভম্ব নয়, চরম আঘাতপ্রাপ্ত ও অপমাণিতবোধ করেছি নাটকটি দেখে। বিবেকের বিপর্যয় দেখেছি। এতোটা অসম্মান বোধ করেছি যে তা বর্ণনাতীত। কারণ, আমাদের পরিবারে একজন বিশেষ বৈশিষ্ঠ্যসম্পন্ন সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়েছিল। যার কোলজুড়ে সন্তান জন্মেছিল সেই মায়ের তখন বয়স ছিলো মাত্র ১৮ বছর। উচ্চমাধ্যমিক পড়তে পড়তে তার বিয়ে হয়। তার পরের বছরই তার কোলে আসে বিশেষ শিশু। বিশেষ শিশুর মায়ের বয়স যখন মাত্র ২১ বছর তখন তার বাবা সেনাকর্মকর্তা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। বাবার বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। শুরু হয় বিশেষ সন্তানকে নিয়ে মায়ের একক কঠিন সংগ্রামের জীবন। সন্তান নিয়ে তিনি একদিকে, সমাজ আর একদিকে। জীবনের ভোগবিলাস, আনন্দ ত্যাগ করে মা কীভাবে জীবনযাপন করেছেন তা যারা দেখেছেন, কেবল তারাই জানেন। এমন কি পরিণত বয়সে এই বিশেষ সন্তান বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হবার কারণেই অভিজাত হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা না পেয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলেও যান।
আরও একটি ঘটনা বলার প্রয়োজনবোধ করছি। একটি বিশেষ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল ছিলাম। একজন তরুণী মা এলেন তার বিশেষ কন্যাকে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করাতে। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে শোনালেন তার গল্প। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে করতেই তার প্রেম এবং তারপর বিয়ে। স্বামী ও স্ত্রী দুজনই শিক্ষার্থী। গর্ভে সন্তান এলে নাখোশ হন স্বামী ও শাশুড়ি। শুরু হলো নানা রকম ঔষধ সেবনের মাধ্যমে গর্ভপাত ঘটানোর লাগাতার চেষ্টা। কিন্ত গর্ভপাত আর ঘটে না। কালক্রমে সময় আসে সন্তান প্রসবের। দাঈ দিয়ে ঘরে প্রসব করানো হয়। বিশেষ সন্তান জন্ম নেয়। তখন এমন সন্তানের জন্য মাকে দোষারোপ করা শুরু হয়।
উল্লিখিত দুটো ঘটনাই বাস্তব ও সত্য। এমন অজস্র ঘটনা আছে যা ইউটিউবের ‘ঘটনা সত্য’ নাটকটির মতন নয়। মঈনুল সানু রচিত রুবেল হাসান পরিচালিত ঘটনা সত্য নাটকটিতে যে ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে তাতে উল্লিখিত দুটো ঘটনার দুজন মাসহ বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সন্তানের অভিভাবকদের চরমভাবে অপমাণিত, অশ্রদ্ধা করা হয়েছে যা তারা করতে পারেন কিনা, প্রশ্ন সেটাই। বিশেষ সন্তানকে নিয়ে বাবা ও মা যে কত কষ্ট করেন, জগতে তারা যে কত ত্যাগ করে চলেন, সেই তথ্য সম্ভবত নাট্যকারের জানা নেই। জানলে অন্ততঃ সেই অভিভাবকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে নাটকের পরিসমাপ্তি টানতে পারতেন। যদিও নাটক তিনি শুরু করেছিলেন দুই ‘চোর’ চরিত্রকে উপস্থাপন করে। একজন চোর হলেন গৃহকর্মী ও আর একজন চোর হলেন গাড়িচালক। চুরি করাকে তিনি পাপ বুঝিয়ে বিশেষ সন্তান প্রসবকে সেই পাপের ফল বুঝাতে চেয়েছেন বলে নাটকে স্পষ্ট হয়েছে ! কী সাংঘাতিক নিমর্ম উপলদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি! আবার একজন গৃহকর্মী খাবার, কানের দুল ও একজন গাড়িচালকের তেল, মবিল, মালিকের ফাইল চুরিকে মহাপাপ হিসেবে দেখলেন সমাজে বিশাল বিশাল চোর ও চুরির ঘটনা থাকতে ? এই সমাজে তো উল্লেখযোগ্য বিত্তবানই অনৈতিক, অনিয়ম, দুনীর্তি, চুরিচামারি ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন, তাই না ? সবার ঘরে কী বিশেষ শিশু আছে ? নিশ্চয়ই না। নাটকে তারা যে ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন তাতে যদি দেখাতেন যে, খাবার বা তেল চুরি করে গৃহকর্মী কিংবা গাড়িচালক ধরা পড়েছে এবং কাজ হারিয়েছে, তাহলে বলা যেত চুরি করা ঠিক হয়নি তাদের। শাস্তি হিসেবে তারা কর্মসংস্থান হারিয়েছে। যেমন রাষ্ট্রে আমরা দেখি চুরিচামারি, দুনীর্তির ঘটনাগুলো কখনো চাপা থাকে না । বরং একটা সময়ে প্রকাশ পায় এবং অন্যায়কারীর ধরা পড়ে, তাদের শাস্তি হয়। মানি লোকদের কোমড়ে দড়ি বেঁধে পুলিশ তাদের নিয়ে যায়। আরও একটি বিষয়, নাটকের একটি পর্যায়ে দেখানো হলো গৃহকর্মী গৃহকত্রীর উপর অসন্তোষ্ট, বিরক্ত হয়ে চায়ের মধ্যে নিজের থু থু মেশালেন এবং সেটা পরিবেশন করলেন ! কী সাংঘাতিক নেতিবাচক ও অপরাধপ্রবণ আচরণের প্রদর্শণ ! খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, ইউটিউবে যে সব নাটক দেখানো হয় তার সেন্সর করা হয় কিনা ? আর কী করে নগদ এর মতো একটি সংস্থা এমন নাটক স্পন্সর করে বুঝা মুশকিল। নাটকটি নগদ এর বিজ্ঞাপনে প্রচারিত হচ্ছিলো বলেই এই কথা বলছি। সস্তা বিনোদনে কিন্ত এখন মানুষ বিনোদিত হয় না, বিব্রত ও সোচ্চার হয়।
মানবসন্তান সৃষ্টিকর্তার আর্শীবাদ, অভিশাপ নয়। সেই সন্তান পৃথিবীতে যে কোনো বৈশিষ্ট্য নিয়েই ভুমিষ্ঠ হতে পারেন। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া যা কেউ জানেন না, জানবার ক্ষমতা রাখেন না। তবে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অনুমান করবার ক্ষমতা দেন সচেতন হতে, জীবনকে কীভাবে সুস্থ ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করতে হবে তা নির্ধারণের জন্য। সেই কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মাধ্যমে গর্ভবতী নারীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক যত্ন নিশ্চিত করবার বিষয়টি মূখ্য হয়ে ওঠে যেন মা ও নবজাতক সুস্থ থাকেন। আর একজন সুস্থ সন্তান পেতে খাওয়াদাওয়া, পরিচর্যায় মা ও বাবা অনেক যত্নশীল থাকেন। কিন্তু তারপরও অনেক সময় বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়। যার অনুমানজনিত কোন কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানে পাওয়া যায়, আবার অনেক সময়ে পাওয়া যায় না।
প্রতিবন্ধিতা নিয়ে অনেক কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা ছিলো। সেই সময়টা কিন্তু বেশ পেছনের। নানান প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকুলতার মাঝে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানবমর্যাদা ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাই বাংলাদেশ সরকার ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩’ প্রবর্তন করেছে।
পরিশেষে বলবো, সংস্কৃতির চর্চাটা যদি ব্যক্তিকে সম্মান দিতে, শ্রদ্ধা করতে না শেখায়, না পথ দেখায় এবং সেটা যদি বিবেক বর্জিত হয়, তাহলে তার দরকার কী ? সমাজের সুস্থতা সৃষ্টির দায় ও দায়িত্ব তো কমবেশি সকলেরই, তাই না ? লেখাটি যখন শেষ করলাম তখন একটা ম্যাসেজ এলো, ঘটনা সত্য নাটকটির কলাকুশলী ও শিল্পীরা ক্ষমা চেয়েছেন।
স্বপ্না রেজা: কলাম লেখক ও কথাসাহিত্যিক