কাজী হানিয়াম মারিয়া: মানুষ নিজেদের অনেক ভালোবাসে। তাই নিজের লাশের জন্য অনেকে কবরের জায়গা কিনে রাখে, কাফনের কাপড় আল্লাহর ঘর ছুইয়ে নিয়ে আসে। মৃত্যুর পর তার নিবাস ঠিক রাখার জন্যও কতো তৎপর থাকে। আমরা ধরেই নিই যে আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হবে, আত্মীয়স্বজন দোয়ার মাধ্যমে আমাদের এই পৃথিবী থেকে বিদায় দিবে। এতো আয়োজনের কথা জীবিত থাকা অবস্থায় ভাবতেও কতো কষ্ট হয় আমাদের যে একদিন এই পরিচিত গন্ডিতে আমি প্রিয়মানুষগুলোর পাশে থাকবো না।
রূপগঞ্জের আগুন নিভানোর কাজে জড়িত একজন দমকল কর্মীর কথা শোনার পর থেকে খুব অস্থির লাগছে। শ্রমিকদের সেখানে বাইরে থেকে বন্দী করে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে। ওরা মারা যায়নি, মেরে ফেলা হয়েছে-আমি এটাই বলবো। আগুনে পুড়ে মারা যাবার পরও যেন তাদের স্বজনরা তাদের চিনতে পারে, তাই নিজের নাম ওয়ালে লিখে তারপাশে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছে। সামনে থেকে আগুন ধেয়ে আসছে, নিশ্চিত মৃত্যু দিকে তাকিয়ে থাকা। এটা কোনো মুভির দৃশ্য নয়। ন্যূনতম বিবেকবোধ থাকলেও আপনার এই দৃশ্যের কথা ভেবে বুক কেঁপে উঠার কথা। অনেক মৃত শ্রমিকের হাতে তাদের আইডিকার্ড পাওয়া গেছে। স্বজনরা যেন অন্তত তাদের লাশ খুঁজে পায়। তারা যে স্বজনদের ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়নি তার জন্য, ভেতরে পুড়ে গেছে তা বোঝানোর জন্য অনেকে ওপর থেকে নিজেদের জুতোতে নাম লিখে নিচে ছুড়ে মেরেছে। চলে যাবার আগেও তারা স্বজনদের নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। চোখ বন্ধ করার আগে প্রিয়মানুষদের মুখগুলো বুঝি কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। আমি নিশ্চিত কোনো মা তার বাচ্চা কী খাবে পরের বেলায় তা ভেবেও কষ্ট পাচ্ছিলো।
ফ্যাক্টরিগুলোতে আগুন নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা না থাকার ফলে বারবার এই ঘটনাগুলো ঘটছে। কতোশতো শ্রমিক নিখোঁজ এবং বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হচ্ছেন। তাই তারা এখন নিজেদের লাশ যেন বেওয়ারিশ না থাকে, আত্মীয়স্বজন যেন তাদের খবরের আশায় না থাকে, তাই নিজেরাই নিজেদের খবর দিয়ে যাচ্ছে। গরিব শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাস আর চিৎকারে নির্মিত বিলাসবহুল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে মালিকপক্ষ রাতে আরামে ঘুমায়। তাদের বেওয়ারিশ বা নিখোঁজ হওয়ার চিন্তা নেই। বরং তারা ভাবেন নিজেদের এপিটাফের পাথর কোথা থেকে আনবেন, কবরস্থানের ভিআইপি জোনে জায়গা কিনে রেখেছেন। তাই শ্রমিকদের চিৎকার তাদের কানে যায় না, চাপা পরে থাকে ওই বদ্ধ গুদামঘরে। এসবের বিচার কি আদৌ হবে? ফেসবুক থেকে