নিউজ ডেস্ক: চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। মহামারী পরিস্থিতিতে বাণিজ্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহে স্থবিরতার প্রভাবে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এতে বাজেটে বড় ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে করোনা মোকাবেলায় সরকারের ব্যয়ও বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারি ভ্রমণ ব্যয়ের ক্ষেত্রে বরাদ্দের অর্ধেক স্থগিত রাখা হচ্ছে। এছাড়া সব ধরনের রুটিন ভ্রমণ পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। সরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি কেনার ক্ষেত্রেও স্থগিত থাকবে বরাদ্দের অর্ধেক। অর্থ বিভাগ থেকে গতকাল এ-সংক্রান্ত দুটি পৃথক পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
ভ্রমণ ব্যয়-সংক্রান্ত গতকাল জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শুধু জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় ভ্রমণ ব্যয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা যাবে। তবে ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত থাকবে। এছাড়া সব ধরনের রুটিন ভ্রমণ পরিহার করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি ভ্রমণ খাতে সর্বমোট ২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ হাজার ২৪০ কোটি টাকা, তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা।
অন্য এক পরিপত্রে বলা হয়, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নতুন গাড়ি কেনায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ অর্ধেক ব্যয় করা যাবে। তবে নতুনভাবে গাড়ি না কেনাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এদিকে চলতি অর্থবছর বাস্তবায়নাধীন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নিম্ন অগ্রাধিকার বা কম গুরুত্বপূর্ণ এবং মধ্যম অগ্রাধিকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ খরচ বন্ধের নির্দেশ দেয়ার কথাও ভাবছে অর্থ বিভাগ। এক্ষেত্রে মধ্যম অগ্রাধিকার প্রকল্পের যেসব খাতে অর্থ ব্যয় না করলেই নয়, এমন টাকা খরচের ক্ষেত্রে কঠোর বিবেচনায় নিতে বলা হবে। কিন্তু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পের অর্থ ব্যয় অব্যাহত রাখতে বলা হবে। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করবে অর্থ বিভাগ। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো এ পরিপত্রের আওতার বাইরে রাখা হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব আদায়ের বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীও প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) রাজস্ব আহরণে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। করোনার মহামারী এখনো বিরাজ করছে, কবে শেষ হবে তা জানা নেই। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে বিশাল ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে করোনার কারণে ভ্যাকসিন ক্রয়সহ স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটছে সরকার।
জানা গেছে, সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে ধস দেখা দেয়। এতে লক্ষ্যমাত্রা ২৯ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীও অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এনবিআরের সর্বশেষ রাজস্ব আহরণ অগ্রগতি-সংক্রান্ত সাময়িক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চলতি অর্থবছর সংস্থাটিকে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে হবে। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ২ লাখ ৬২ হাজার ১১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এনবিআর নিজেই। কিন্তু এ সময়ে আহরণ হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরেও এনবিআরকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে গত অর্থবছরের পুরোটাতেই ছিল করোনার ছোবল। এতে করে মানুষের আয় কমে গেছে। তাই চলতি অর্থবছরে আয়কর আহরণে ব্যাপক ধস নামার পাশাপাশি সার্বিক রাজস্বেও বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ আগের অর্থবছরের আয়ের ভিত্তিতে পরের অর্থবছরে আয়কর দেন করদাতারা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনায় জনজীবনে স্থবিরতা বিরাজ করছে, এ অবস্থায় রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার ব্যয় কমানোর যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা যথার্থ। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আমাদের অনেক বেশি ব্যয় হয়। এসব ক্ষেত্রেও ব্যয় সংকোচনের সুযোগ রয়েছে। - বণিক বার্তা