আলী রিয়াজ: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের বাদ দেবার সুপারিশ করেছে সংসদীয় একটি কমিটি। খবরটি একাধিক কারণে কৌতুহলোদ্দীপক। এই কমিটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আলোচনা তাঁদের এখতিয়ার কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সকল নাগরিকের যে সমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা তাঁদের এই ধারণা যে, তার সম্পূর্ণ বিপরীতে সেটা কী তাঁরা বুঝতে অপারগ নাকি অনীহ ? নাগরিকের সমতার অধিকার বিষয়টি বাংলাদেশে বিভিন্নভাবেই অপসৃত; জেন্ডারের ক্ষেত্রে তো আরও প্রকটভাবে প্রকাশিত। অথচ বাংলাদেশের সরকার এবং অন্যান্যরা নারীদের অগ্রযাত্রাকে সাফল্য বিবেচনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা না হ্য উল্লেখ নাই ক্রলাম। কিন্ত কেনো কমিটিকে হঠাৎ করে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে? “কোন যুক্তিতে এই সুপারিশ জানতে চাইলে সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহিলা ইউএনও গার্ড অব অনার দিতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন।” আমার নিবোর্ধ মনে প্রশ্ন হচ্ছে – এই অনেকে কারা? আগামীকাল এই ‘অনেকে’ যদি মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তাহলে কি তারও বিকল্প খোঁজা হবে? এই সুপারিশের জেন্ডারের দিকটা তো আপনি চাইলেও এড়াতে পারবেনা না। সেটা নিয়ে বিস্তর কথাও হচ্ছে। কিন্ত জেন্ডারের প্রশ্নে এই ধরণের সিদ্ধান্ত কি আসলেই নতুন ?
‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নারী হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড হবেন পুরুষ। এসিল্যান্ড পদে নারী কর্মকর্তা পদায়নের ক্ষেত্রে যে উপজেলায় ইউএনও পুরুষ সেই উপজেলাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এসব বিধান রেখে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন নীতিমালা করছে সরকার’ – এই খবরটি ১ ফেব্রুয়ারির। অনেকের চোখে পড়েছে, অনেকের হয়নি। এই নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছে এমনটা মনে করতে পারিনা। কিন্ত এর সার কথাটি বোধগম্য। যোগ্যতা বা প্রশাসনের প্রয়োজন নয় – জেন্ডার হচ্ছে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এটাই হচ্ছে সরকার। রাষ্ট্র নিজেই একটা লিঙ্গায়ীত প্রতিষ্ঠান - জেন্ডার্ড এনটিটি। এর মধ্যে যদি সরকারের বিবেচনার বিষয় হয় এই ব্যবস্থাকে অক্ষত রাখা এবং তাঁকে শক্তিশালী করা তবে এটাই স্বাভাবিক।
সেই স্বাভাবিকতার ধারাবাহিকতায়ই বিয়ে নিবন্ধনে নারীরা কাজী হতে পারবে না বলে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এই বিষয়ে আইনি চ্যালেঞ্জের সূচনা হয় ২০১৪ সালে, ছয় বছরে ধরে এই মামলা চলেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এসে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা রিটের রায় দেয়া হয়। সেই রায়ের পূর্নাঙ্গ রায়ের বিবরণ পাওয়া যায় এই বছরের জানুয়ারিতে। এর বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংক্ষুব্ধ পক্ষ। কিন্ত এটা কেবল আইনি বিষয় নয়, এমনকি কেবল নিকাহ রেজিষ্ট্রার নিয়োগের প্রশ্নও নয়। এই মামলায় আয়েশা সিদ্দিকার পরিবর্তে যাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো সেই সেকান্দার আলীর পক্ষের আইনজীবী আদালতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ‘নিকাহ রেজিস্ট্রারের মৃত্যু বা অবসরে যাওয়ার কারণে পদটি শূন্য হলে তাঁর পুত্রসন্তান যোগ্যতা থাকলে অগ্রাধিকার পাবেন’ – এটা আইনেই লেখা আছে। ফলে এক ধরণের জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশনের ব্যবস্থা আইনেই আছে। তদুপরি যারা আদালতের রায় নিবিড়ভাবে পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয় যুক্তিগুলো দেখেছেন। রায়ে বিচারকরা বলেছেন ‘এটা বাস্তবসম্মত প্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন।’ বাস্তবতার যুক্তি হচ্ছে যে কোন ধরণের অন্যায্য ব্যবস্থাকে বহাল রাখার চেষ্টা মাত্র।
গার্ড অব অনারের বিষয়টি একেবারে আলাদা করে ভাবার অবকাশ নেই। একে দেখতে হবে রাষ্ট্রের অন্যান্য আচরণের সঙ্গে মিলিয়ে – কী করে নাগরিকের সমতার ধারণাটি এখন আর কারো বিবেচনায় থাকেনা। সমতার ধারণাই যখন অনুপস্থিত হয় তখন সকলেই কোন না কোন ভাবে বঞ্চিত হবেন। আর বুঝতে হবে প্রতিকী সাফল্য বা উপস্থিতি ক্ষমতায়নের উপায় নয়; প্রতিষ্ঠান এবং আইনি ব্যবস্থাগুলোকে বহাল রেখে কেবল প্রতীক দিয়ে এই অসাম্যকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আরও বিভিন্নভাবেই এই অসমতা প্রকাশিত হয়। আপনার চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন।
Distinguished Professor, Politics and Government at Illinois State University