মমতাজুর রহমান: বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায় পাড়াগায়েঁ শিক্ষার্থীদের জীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে স্মার্টফোনের নানা গেমস। তাদের শৈশব জীবন থেকে ধুলাবালি মাখা দুরন্তপনা দিনগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে এখন আর কিশোরদের তেমন ঐতিহ্যবাহি খেলাগুলি খেলতে দেখা যায় না। করোনা মহামারিতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বন্ধ প্রাইভেট,কোচিংও। এই সুযোগে গ্রামের শিক্ষার্থীরা মেতে উঠেছেন স্মাটফোনের গেমসে। ফেসবুক, আর গেমস খেলে তাদের দিন-রাত কাটে এখন। ফলে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে তাঁদের।
আদমদীঘি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দলবেধে বিভিন্ন স্থানে সকাল থেকে দুপুর এবং দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গেমস খেলছে। এই গেমস খেলতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের বাবা-মার কাছ থেকে অনেকটা জোড় করে মোবাইল কিনে নেয়। প্রতিদিন গেমস খেলতে আবার মাসে ৪০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করে।
এই টাকাও তারা তাদের বাবা-মার কাছ থেকে জোড় করে নেয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সকল গেমসে নানা চরিত্র টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এই রকম একটা জনপ্রিয় খেলা ’ফ্রি-ফেয়ার’। এই গেমস খেলতে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে অনলাইন ক্লাস করার কথা বলে টাকা নেয়। সারাক্ষন মোবাইলে গেম খেলতে গিয়ে এবং গভীর রাত পর্যন্ত জেগে শিক্ষার্থীরা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাদের কথা বার্তায় উগ্রতা দেখা দিচ্ছে। ফলে সমাজে কিশোর অপরাধ বাড়ছে।
উপজেলার সান্তাহারের রথবাড়ি মহল্লার বাসায় বাসায় কাজ করে রহিমা নামের এক দরিদ্র মহিলা। তিনি জানান, তার ছেলে একটা দোকানে কাজ করতো। ঐ কাজ ছেড়ে সে তার কাছ থেকে জোড় করে ২২ হাজার টাকা নিয়ে মোবাইল কিনে এখন সারক্ষন মোবাইলে গেম খেলে। এই খেলায় কেউ বাধা দিলে এই সকল শিক্ষার্থীরা তাকে শত্রু মনে করেন। ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে কিশোর গ্যাং। গ্রামের মাতব্বররা আগের মতো এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে না।
গত সোমবার বিকেলে আদমদীঘির পাশ্ববর্তি একটা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল একটা স্কুল মাঠে একদল কিশোর-তরুণেরা গায়ে গা লাগিয়ে গেমস খেলায় ব্যস্ত। তাঁদের হাতে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা দামের স্মার্টফোন। তাঁরা বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে খেলছে। একজন শিক্ষার্থী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, রাত ১০ টা থেকে খেলা শুরু করে ভোরের আজান পর্যন্ত খেলেন তিনি। তিনি আরো বলেন, এখন মনে হচ্ছে স্কুল খুললে গেমস খেলতে না পারলে বোধ হয় মারাই যাবেন।
তিনি স্বীকার করেন, এখন তাঁদের চোখে সমস্যা ও অনান্য শারিরীক সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রতি মাসে তার এই খেলার পেছনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা ব্যয় হয়। জানা গেছে সান্তাহারে মহিলারাও কেউ কেউ এই গেমস খেলছে। কেউ কেউ আবার মাসে পাঁচ দশ হাজার টাকা আয় করছে। মোবাইলের এই সকল খেলায় ফেসবুক আইডি লাগে, লাগে পাসওয়ার্ড। কোন কোন শিক্ষার্থীর ৭/৮টি করে ফেক আইডি আছে। এদের অনেকেই ক্রিকেট খেলার সময় ঐ খেলা নিয়ে জুয়া খেলে।
সান্তাহার নাহার মেডিকেয়ারের চিকিৎসক ডাঃ হামিদুর রহমান রানা এবং স্থানীয় একটা কলেজের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক জিয়াউল হাসান বলেন, তাঁরা এটাকে সেলফোন আ্যডিকশন ও নন-ড্রাগ অ্যাডিকশন বলছেন। মাদক নয়, কিন্তুু তাতে আসক্ত আছে। এ ধরনের প্রচুর রোগি তাঁরা পাচ্ছে। আমরা মনে করি অবিলম্বে এই সকল গেমস বন্ধ করা উচিত।
আদমদীঘি থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোঃ জালাল উদ্দীন বলেন, এটি একটি সামাজিক অবক্ষয়। বর্তমানে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তবে অভিভাবকদেরও এ বিষয়ে দায়িত্ব আছে। সমাজের সকল শ্রেনীর মানুষদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত।
সান্তাহার নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মোসলেম উদ্দীন বলেন, মহামারি করোনাকালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এই সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে মোবাইল থেকে ঐ সকল খেলা বাদ দিতে হবে। গ্রামের শাসন ব্যবস্থাও মজবুত করতে হবে।