মাহবুবুর রহমান: করোনা সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য-উপাত্ত নাই।দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের দেশে সকল স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। দীর্ঘ ১৪ মাস দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ,কখন খুলবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর কিভাবেই বা খুলবে?
বৈশ্বিক করোনা ভাইরাসে ও মহামারিতে সারা পৃথিবী আজ লন্ডভন্ড । প্রবাসে দীর্ঘদিন সর্তক ভাবে থাকার পরও করোনায় পরিবার সহ আক্রান্ত হয়ে ছিলাম। আমার দুই ছেলেই ডেনমার্কে করোনা বিষয়ক স্বাস্হ্যবিধি মেনে স্কুলে যায় এবং আমি তাঁদের প্রতিদিন স্কুল গেইটে পৌঁছে দেয় ও স্কুল শেষে বাসায় নিয়ে আসি।
বড় ছেলে ইনান এই বছরই ১৮ হলো,সে কলেজে পড়ে গতমাসে তাঁর করোনা পজিটিভ ছিল,৪দিন ভোগার পরে ভাল হয়ে গিয়েছে এবং বর্তমানে সস্পূন্ন সুস্হ।ছোট ছেলে ইশান ১১ বছর শরীরে শক্ত ইমিউনিটি থাকার কারণে অদ্যবধি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় নাই।এটা ডেনমার্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করেন, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে।
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ডেনমার্কে শুরু হওয়ার পর থেকে ডেনিশ সরকার বেশ কয়েকবার বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গুলি খুলে দিয়েছিল এবং বন্ধও করেছে কয়েকবার,তবে এই বছর এপ্রিলের মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এখন পর্ষন্ত সস্পূন্ন খোলা আছে।
শেষ পর্ষন্ত কিভাবে ডেনমার্কের স্কুল-কলেজগুলি ডেনিশ সরকার পরিকল্পনা মাফিক চালু রাখবে সেই বিষয়গুলি সস্পর্কে লিখে জানানোর চেষ্টা করছি,যা আমাদের দেশের জন্য বা পাঠকদের জন্য উপকারে আসতে পারে।
প্রথমত আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে,আমরা করোনার সাথে বসবাস করে বেঁচে থাকাবো এবং তাঁর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে অভ্যাস গড়ে তুলবো।
ডেনিশ সরকার নিশ্চিত হতে পেরেছে যে,সেখানে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে এবং যেভাবেই হোক করোনার বিস্তারকে 'নিয়ন্ত্রণে' রাখতে হবে।স্কুল-কলেজ খুলে রাখার ব্যপারে সরকারের কঠোর নির্দেশিকা রয়েছে,যা প্রতি সপ্তাহে হালনাগাদ হয় অর্থাৎ ১১ বছরের উপরের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল কতৃপক্ষের কাছে সপ্তাহে কমপক্ষে ২বার করোনা নেগেটিভ ট্রেষ্ট সার্টিফিকেট দেখাতে হবে,অন্যথায় স্কুলে আসতে পারবে না।
প্রতিদিন প্রতিটি ছাত্রকে অন্তত পাঁচ বার হাত ধোয়া বাধ্যতামূলক।যেখানে হাত ধৌতকরনের নিয়মাবলী থাকবে এবং কমপক্ষে সাবান দিয়ে ৫০সেকেন্ড সময় নিয়ে হাত ধুতে হবে। সামাজিক দূরত্বের জন্য দুটি ডেস্কের/বেঞ্চের মধ্যে দুই মিটার দূরত্ব থাকতে হবে, যদিও সময়ের সাথে সাথে দুরত্ব কমিয়ে এক মিটার করা যেতে পারে। কোন ক্লাসে ৩০জন্ ছাত্র-ছাত্রী থাকলে ১৫ জনের উপস্থিতিতে ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। এইক্ষেত্রে প্রতিটি ছাত্র একদিন পরপর স্কুলে ক্লাস করার সুযোগ পাবে,কারন শারীর দুরত্ব রাখার কারনে একটি ক্লাসে আগের তুলনায় বসার সীট কমে যাবে। ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যক্তিগত শারীরিক অবস্হা ও পরিবারের সদস্যের শারীরিক অবস্হার সংবাদ স্কুলকে জানানোর ব্যপারে ছাত্র-ছাত্রীদের বেশী দায়িত্ববান করে গড়ে তুলতে হবে।
প্রতিটি স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারীদের স্বাস্হ্যবিধির ব্যপারে পরিস্কার ধারনা থাকতে হবে। ধীরে ধীরে স্কুল- কলেজের ছাত্র-ছাত্রদের মধ্যে সামাজিকীকরণের পরিমাণও বাড়ানো দরকার তবে সেটা সময় এবং সুযোগের উপর নির্ভর করছে।
স্কুল বা কলেজে আসার কারনে বা অন্য কোথাও থেকে কোন ছাত্র/ছাত্রী বা তাঁর পরিবারের কোন সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অবশ্যই কমপক্ষে দুই সপ্তাহ উক্ত শিক্ষক/ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে আসতে পারবে না।এবং কোভিড-১৯ নেগেটিভ সিটিফিকেট স্কুলে পাঠানোর পরে স্কুলে যেতে পারবে। স্কুল কতৃপক্ষকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক সরবরাহ করার ব্যবস্হা থাকা জরুরী। প্যানডেমিক সময়ে কোন অভিভাবক স্কুলের ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না।সেইজন্য স্কুল গেইটে কঠোর নিয়মে নীতি বেঁধে দেওয়া জরুরী। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ক্লাসে বসার সীট নির্ধারণ করা থাকবে,ইচ্ছা মাফিক সীট পরিবর্তন করা যাবে না।
স্কুলের শ্রেণী শিক্ষকদের সাথে অভিভাবকদের ইমেল বা ভার্চুয়াল যোগাযোগ থাকবে,এবং মাসে কমপক্ষে দুইবার ভার্চুয়াল মাধ্যমে শিক্ষক- অভিভাবক বা স্কুল প্রতিনিধির সাথে মি অভিভাবকদের মিটিং বা মতবাদ আদানপ্রদান হতে পারে।
স্কুল বা কলেজগুলি বিশেষ স্বাস্হ্যবিধি ও বিধি-নিষেধ অনুসরন করছে কিনা তাঁর জন্য শিক্ষামন্ত্রালয়ের অথবা স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের বিশেষ প্রতিনিধিরা স্কুল/ কলেজে যে কোন সময় বিশেষভাবে মনিটরিং থাকবে। স্কুল- কলেজ বা শিক্ষক/কর্মচারী স্বাস্হ্যবিধি ও বেঁধে দেওয়া নিয়ম বা আইন ভঙ্গ করলে আইনগত ভাবে দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে,সাথে জরিমানা বা শাস্তির ব্যবস্হা রাখতে হবে।
সকল স্বাস্হ্যবিধি ও নিয়ম-নীতি মেনে চলার পরে,কি পরিমান ছাত্র-ছাত্রী কেভিড-১৯এ আক্রান্ত হচ্ছে ও তাঁর % কত? এবং কোন কোন কারনে আক্রান্ত হচ্ছে সেইবিষয় গুলি খুঁজে বের করে,সংশোধিত স্বাস্হ্যবিধি প্রণয়ন করা যেতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীরা সকালের ও দুপুরের খাবার অবশ্যই প্যাকেট করে বাসা থেকে আনতে হবে।স্টাফ ক্যান্টিন বা রান্নাঘর বন্ধ থাকবে এবং শিক্ষকেরা তাদের নিজস্ব কফি বা পানীয় নিজেরাই ব্যবস্হা করবেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা টয়লেট গুলিকে হাইজেনিক রাখা তাই,-টয়লেটে নম্বর সিস্টেম রাখতে হবে।
১১ বছরের নীচে বাচ্চাদের জন্য কোন মাস্ক পরা জরুরী নয়।তবে ১১ বছরের উপরের বাচ্চাদের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলেক ।
একেক ক্লাসের শিক্ষার্থী একেক টয়লেট ব্যবহার করবে। এতে একই টয়লেট সবার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকতে হবে।
শিক্ষার্থীদের ছয়জন/ আটজন গ্রুপে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া যেতে পারে । উদাহরণস্বরুপ ৩০ জনকে অবাধে মেশার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে বা সম্পূর্ণ ক্লাস একত্রে একে অপরের সাথে মিশতে পারে।তবে এক ক্লাসের ছাত্র অন্য ক্লাসের ছাত্র/ছাত্রীর সাথে মেলামেশা বা খেলাধুলা করতে পারবে না।
পড়ালেখার কথা ভেবে পার্টটাইম অতিরিক্ত শিক্ষক বা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।কারন স্বাস্হ্যবিধি মেনে চলতে অতিরিক্ত লোকবল প্রয়োজন হবে। শ্রেণিকক্ষের আকার ছোট করে শিক্ষকরা যাতে দূরত্ব রাখতে পারেন সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে । যতটা সম্ভাব স্কুলের দরজা-জানালা খোলা রেখে বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের সুযোগ রাখতে হবে। আবহাওয়া ভাল থাকলে খোলা জায়গায়/ খোলা আকাশের নিচে ক্লাসের ব্যবস্হা করা যেতে পারে।প্রতিদিন স্কুলে নিদিষ্ট একটা সময় শারীরিক ব্যায়ামের ব্যবস্হা থাকতে পারে।ইংরেজী, বাংলা ক্লাশের মতো।
সবচেয়ে বড় কথা বাচ্চাদের সুরক্ষিত রাখা এবং পিতামাতা ও শিক্ষকদের মধ্যে আস্থা তৈরি করার ওপর জোর দিতে হবে ।
১৪ মাস স্কুল- কলেজ বন্ধ রেখে সামাধান খোঁজা কোন প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিমত্তামূলক মৌলিক বা ভাল ফলাফল বয়ে আনবে না।সমস্যার মধ্যে থেকেই সমস্যার সমাধান বের করার প্রচেষ্টায় শ্রেষ্ঠ উপায়। যেখানে বাংলাদেশের সার্ভিস সেক্টরগুলি খুলে রাখা হয়েছে সেখান স্কুল- কলেজ খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের জোর প্রচেষ্টা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, ডেনমার্ক আওয়ামী লীগ