ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] আমাদের নতুন সময়কে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে অরল্যান্ডো হেলথ, অরল্যান্ডোর-এর ইন্টারনাল মেডিসিন, বক্ষব্যাধি, ক্রিটিকাল কেয়ার ও নিউরোক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রুমি আহমেদ খান বলেন, রাশান ভ্যাকসিন ভালো কাজ করে, স্পুটনিকের চেয়ে কম হলেও সিনোভ্যাক যথেষ্ট কার্যকরী এবং দুটো ভ্যাকসিনই খুব সেইফ
[৩] ঢাকার সাম্প্রতিক ওয়েভ ঢাকাবাসীকে অন্তত কয়েক মাসের জন্য হলেও প্রটেক্ট করার কথা
[৪] জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাই নিশ্চিত করা ও হাই ফ্লো ক্যানুলা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।
[৫] খুব দ্রুত দেশকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
[৬] বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি কেমন দেখছেন। সংক্রমণ ৮-এর ঘরে। মৃত্যু কমছে। এতে কী বোঝা যায়, দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে পারছে সরকার? ডা. রুমি আহমেদ খান : ঢাকার পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে ভালোর দিকে মনে হচ্ছে, সরকারি ডাটা এবং পারিপার্শ্বিক তথ্য অনুযায়ী। তবে ঢাকার বাইরের বাকি বাংলাদেশের অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে, বলা মুশকিল। কারণ নির্ভরযোগ্য তেমন উপাত্ত নেই। আমার ভয় ভারতের ওয়েভটা দেশে এলে ঢাকার বাইরে প্রথম বেশি আঘাত হানার কথা।
ঢাকার সাম্প্রতিক ওয়েভ ঢাকাবাসীকে অন্তত কয়েক মাসের জন্য হলেও প্রটেক্ট করার কথা। তবে পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করবে ঢাকাবাসীর বর্তমান এন্টিবডি প্রটেকশন ভারতের বর্তমান ডোমিন্যান্ট ভ্যারিয়েন্টকে কতোটা প্রতিরোধ করতে পারবে। এ ব্যাপারটা ভবিষ্যৎই বলবে। তথ্য-প্রবাহের এই সংকোচনকালে যখন সঠিক ডাটা নিয়ে মানুষ সন্দিহান, আসল তথ্য পত্রিকাগুলো লিখতে পারছে কিনা তা যখন আমরা জানি না, তখন সরকার ভালোভাবে সামলে দিলেও ক্লিয়ারলি এবং কনফিডেন্টলি সরকারকে বাহবা দেওয়া যায় না, তথ্যের স্বল্পতার কারণে।
[৭] আপনার দৃষ্টিতে, মহামারি মোকাবেলা সরকারের ভুল বা দুর্বলতা কী? ডা. রুমি আহমেদ খান : ভ্যাকসিনেশনের ধীরগতি, লকডাউন কার্যকরণে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত। উদাহরণ দিই। পৃথিবীর সব সরকার ভ্যাকসিন সংগ্রহে একাধিক সোর্সের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে রেখেছে গত বছর থেকে। আমরা শুধু এক সোর্সের ওপর নির্ভর করে বসেছিলাম, যা প্রæডেন্ট হয়নি। আরেকটা উদাহারণ দিই। সরকার নাকি ঘোষণা দিয়েছে- ঈদের জামাত মসজিদের বাইরে পড়া যাবে না। ব্যাপারটা উল্টা হওয়ার দরকার ছিলো। বলা দরকার ছিলো, ঈদ-তারাবি মসজিদের ভেতর পড়া যাবে না। ভাইরাস সংক্রমণের জন্য ইনডোরের চেয়ে আউটডোর অনেক সেইফ। বিশ ভাগের এক ভাগ। সেজন্য নামাজ বাইরে মাঠে রাস্তায় বা মসজিদের ছাদে ছয় ফুট ডিসটেন্ট মেইনটেইন করে পড়া অনেক সেইফ। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মধ্যে রিকশা সবচেয়ে সেইফ। অথচ পুলিশ রিকশা চলাচলে বাধা দিয়েছে। ঈদের সময় শপিংমলগুলো বিকিকিনি করতে পারতো সামনের রাস্তায়, তা অনেক সেইফ হতো।
[৮] লকডাউন কি করোনা মোকাবেলা কার্যকর কোনো সমাধান। বাংলাদেশের জন্য উপযোগী পথ বা পদ্ধতি কী? ডা. রুমি আহমেদ খান: হ্যাঁ, এটা হচ্ছে নেসেসারি ইভিল। এটা করতেই হবে। তবে সোশ্যাল সেফটিনেট মেইনটেইন করে। মানে দরিদ্রদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। লকডাউন কাজ করে সীমিত স্কেলে হলেও।
[৯] ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মে- সংক্রমণ ও মৃত্যু পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনো ভালো আছে। এর কারণ কী বলে আপনি করেন? ডা. রুমি আহমেদ খান : এটার অনেক ব্যাখ্যা আছে। সম্প্রতি বিখ্যাত উইকলি ম্যাগাজিন নিউইয়র্কার-এ প্রফেসর এবং লেখক সিদ্ধার্থ মুখার্জী একটা লং ফর্ম আর্টিকেল লিখেছেন, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। আপনারা এটা পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করে দিতে পারেন। তবে সম্প্রতি ভারতীয় ঘটনা প্রবাহে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে আসলেই কি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মৃত্যুর হার কম। আমাদের দেশের সঠিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে দেশের মানুষেরই সন্দেহ আছে। তবে আমাদের মানুষের ক্রস ইম্মিউনিটি, গ্রামের মানুষের লিভিং কন্ডিশন (ক্রস ভেন্টিলেশন- এসিবিহীন বাসা বাড়ি), ইত্যাদি ফ্যাক্টরও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
[১০] বাংলাদেশের জন্য ভয়ের কিছু কি আছে? ভারতের ডাবল ভ্যারিয়ান্ট কতোটা শঙ্কা বাংলাদেশের জন্য। ভারতীয় ভ্যারিয়ান্ট ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপ কি যথার্থ? ডা. রুমি আহমেদ খান : শঙ্কা অবশ্যই আছে। সেজন্য খুব দ্রুত দেশকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের এযাবৎ যে ডাটা আছে, তাতে আমরা জানি যে ভারতের যে দুটো ভ্যাকসিন আছে এবং এমআরএনএ ভ্যাকসিন এই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে।
[১১] ভ্যাকসিনেশন শুরুর পর জনগণের বিপুল সাড়া, কিন্তু টিকা সংকটে নিবন্ধন করে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভুলটা কোথায় হলো মনে হয় আপনার। ডা. রুমি আহমেদ খান : আগেই বলেছি, এক সোর্সের ওপর নির্ভর করে থাকাটা ঠিক হয়নি। তবে এখনো সময় আছে, নতুন সোর্স খুঁজতে হবে এবং ভ্যাকসিনের দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে।
[১২] রাশিয়ান স্পুটনিক-ভি এবং চীনা সিনোভ্যাক টিকা অনুমোদন কি সঠিক সিদ্ধান্ত? কতোটা কার্যকর দুটি টিকা? ডা. রুমি আহমেদ খান : ভ্যাকসিন যা পাই, তাই সই। এখন আমাদের বাছার সময় না। রাশান স্পুটনিক কাজ করে, ভালোই কাজ করে- ল্যানসেট পেপার অনুযায়ী। সিনোভ্যাক একটু পুরনো ধাঁচের ভ্যাকসিন। তবে এটাও স্পুটনিকের চেয়ে কম হলেও যথেষ্ট কার্যকরী এবং দুটো ভ্যাকসিনই খুব সেইফ।
[১৩] অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ দিয়েছেন যারা, অন্য কোনো টিকা কি দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে তাদের দেওয়া যাবে? ডা. রুমি আহমেদ খান : হ্যাঁ যাবে। আমি কোনো ক্ষতি দেখি না। পুরো কোভিড ভ্যাকসিন বিষয়টা নতুন সায়েন্টিফিক ডেভেলপমেন্ট। যতোদিন যাচ্ছে আমরা ততোই জানছি। আপাতত এটা বলি যে, সবগুলো ভ্যাকসিন (সাইনভ্যাক ছাড়া) ভাইরাসের একটা অংশ স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি ফর্ম করে। কোভিশিল্ডও করে, স্পুটনিকও করে, জনসন অ্যান্ড জনসন করে, ফাইজার-মডার্নাও একই কাজ করে। আর সাইনভ্যাক পুরো ভাইরাসটাকেই ইউজ করে। এখন একটা ভ্যাকসিন শরীরকে স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে প্রাইম করলে পরে ভিন্ন ভ্যাকসিনটা স্পাইক প্রোটিন বেসড হলে এটাকে বুস্ট করার কথা। স্পুটনিক কিন্তু এমনিতেই এদের প্রথম ও সেকেন্ড ডোজে ভিন্ন ভেক্টর ব্যবহার করে। সুতরাং বিজ্ঞান চিন্তায় থিওরেটিকালি এটাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এই নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি।
[১৪] গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স এখনো নীতিগত অনুমোদন দেয়নি বিএমআরসি। বঙ্গভ্যাক্স নিয়ে কি সরকার ভুল করছে? ডা. রুমি আহমেদ খান : গ্লোব বায়োটেককে রিসার্চ সম্পন্ন করার সুযোগ এবং ফান্ড দেওয়া দরকার সরকারের এবং ওদের রিসার্চ ও ডাটাও আইসিডিডিআরবিকে দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে। দেশ থেকেই ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারিং রিসার্চ শুরু হওয়া প্রয়োজন।
[১৫] গরিব-খেটে খাওয়া মানুষের করোনা হয় না, কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, আবার বিশ্বাসও করা কঠিন! বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? ডা. রুমি আহমেদ খান : হয়! জ্বর, অসুখ ইগনোর করে, টেস্ট করে না। তারা মরলেও কেউ কেয়ার করে না। কারণ তারা করোনা টেস্ট করেনি!
[১৬] নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও মানুষ ঘরমুখী। ঈদের পর কি সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে? ডা. রুমি আহমেদ খান : আমি খুব আশঙ্কায় আছি। ঈদের জনসমাগম/ভারতীয় ওয়েভ সবকিছু মিলিয়ে একটা ভয়াবহ থার্ড ওয়েভ আসতে পারে।
[১৭] দেশে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশকেও কি তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলা করতে হবে বলে ধরে নেওয়া যায়? তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলায় কোন পদক্ষেপটি আশু নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আপনি? ডা. রুমি আহমেদ খান : থার্ড ওয়েভ আসুক আর না আসুক- আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হলো ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। প্রথম শিক্ষা হচ্ছে, জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাই নিশ্চিত করা। হাই ফ্লো ক্যানুলা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে সরকারি কোভিড গাইডলাইন জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার সমাজের মাঝে ডিসেমিনেট করা। অপ্রয়জনীয় টেস্ট সিটি স্ক্যান ও ওষুধ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর প্রিডেটরি আচরণ কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রেগুলেশন প্রণয়ন করতে হবে যে, সরকারি গাইডলাইনের বাইরে কোভিড চিকিৎসার ওষুধ কোনো ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের কাছে প্রমোট করতে পারবে না।
[১৮] কোভিডকালে মানুষ নানামুখী চাপে আছে। কর্মহীন অনেকেই। অভাব-অনটন, দারিদ্র্যতায় কষ্টে আছে। এই সময়ে মানসিকভাবে কীভাবে ভালো থাকবে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার উপায় কী? ডা. রুমি আহমেদ খান : ঘরের বাইরে বেরুতে হবে সোশ্যাল বা ফিজিক্যাল ডিস্টেনসিং মেনে। দরকার হলে সন্ধ্যার সময় পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হন। নিজের গাড়ি না থাকলে রিকশা ভ্রমণ করুন। জুম ইত্যাদি মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হন সপ্তাহান্তে। মূল কথা- ঘর থেকে বের হতে হবে। পার্কে যান, আউটডোর অনেক সেইফ।
আপনার মতামত লিখুন :