ডা. লেলিন চৌধুরী: করোনা মোকাবেলায় যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন ছিলো ১৮মার্চ, সেগুলো নেওয়া হলো ২৮ মার্চ। অন্যদিকে ৫মার্চ ৭ দিনের লকডাউন বা নিষেধাজ্ঞার নামে একটি হগা খিচুড়ি অবস্থা তৈরি জরা হলো। আমরা করোনার গতির চেয়ে কমপক্ষে ১০ দিনের মতো পিছিয়ে রয়েছি। গত বছরের করোনা সংক্রমণকে যদি প্রবল বন্যার তোড়ের সঙ্গে তুলনা করি তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণকে সুনামির সাথে তুলনা করতে হবে। এখন যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি-
[১] সরকারি, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসায়িক সকল সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করা।
[২] সকল ধর্মের সমবেত প্রার্থনা স্থগিত করা।
[৩] সকল ধরণের মেলা, বিনোদনকেন্দ্র, বেড়ানোর স্থানসমুহ বন্ধ রাখা।
[৪] বিয়ে, জন্মদিন পালনের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান স্থগিত করা।
[৫] রাত ৯.০০টা থেকে সকাল ৬.০০টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা।
[৬] বিপণিবিতান, শপিংমল, বাজার, দোকানপাট ইত্যাদি ৬ ঘণ্টার জন্য খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া।
[৭ ] যেসকল অফিস অনলাইনে করা সম্ভব সেগুলো অনলাইনে করা।
[৮] যেসব অফিস শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হয় সেখানে শিফটিং ব্যবস্থা করা।
[৯] যেসব বেসরকারি অফিস ৬ ঘণ্টার বেশি সেগুলোকে ৬ঘন্টায় নামিয়ে আনা।
[১০] সকল ধরনের অফিসের জনবল অর্ধেকে নামিয়ে আনা।
[১১] অতিসংক্রমণশীল এলাকাকে রেডজোন ঘোষণা করে সেখানে লকডাউন করা।
[১২] দেশে ‘স্বাস্থ্য রেড অ্যালার্ট’ জারি করা।
[১৩] জনসাধারণকে বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বের হতে নিষেধ করা এবং আন্তঃজেলা ভ্রমণে কড়াকড়ি করা।
[১৪] স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামানো এবং স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গকারীকে কঠোর শাস্তি দেওয়া।
[১৫] প্রতিটি পাড়া, মহল্লা ও এলাকায় গণতদারকি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা।
[১৬] সকল গণপরীক্ষা স্থগিত করা।
[১৭] সকল নির্বাচন স্থগিত করা।
[১৮] প্রয়োজনীয় কোয়ারিন্টাইন কঠোরভাবে পালনের পদক্ষেপ নেওয়া।
[১৯] করোনা ভাইরাসের জিনবিন্যাস নিয়মিত পরীক্ষা করে সময় সময় জনগণকে জ্ঞাত করা।
[২০] করোনা টেস্টের পরিধি বিস্তৃত করা।
[২১] করোনা টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর করা।
[২২] ইতোমধ্যে হাসপাতালগুলোর সামর্থ্যরে শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। অতিদ্রুত অতিসংক্রমণশীল এলাকায় রেডক্রিসেন্ট, সশস্ত্রবাহিনী ও বিজিবি দ্বারা ফিল্ডহাসপাতাল স্থাপন করা।
[ ২৩] মৃদু ও মধ্যম সংক্রান্ত রোগীদের বাসা/বাড়িতে রেখে এবং তীব্র আক্রান্তদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া।
[২৪] মোবাইল মেডিক্যাল টিম গঠন করা। জরুরি প্রয়োজনে বাড়িতে গিয়ে রোগী দেখবে।
[২৫] জরুরিভাবে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য জরুরি অক্সিজেন কেন্দ্র বা ইমার্জেন্সি সাপোর্ট সেন্টার স্থাপন করা।
[২৬] সামগ্রিক অবস্থা জনসাধারণকে বোঝানোর জন্য ব্যাপক প্রচার করা।
[২৭] দায়িত্বপালনে অবহেলাকারীদের আইনের আওতায় আনা।
[২৮] আগের জারি করা বিধিগুলো বলবত রাখা।
[খ] করোনাভাইরাস এক মহাআতঙ্কের নাম। ২০২০-২১ সালে বিশ্বকে এই মহামারি চূড়ান্ত উদ্বিগ্ন ও বিপদগ্রস্ত করেছে। এ পর্যন্ত ২৯ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। মৃত্যুর মুখে মিছিল ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নতুন করে লাখ লাখ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে। পরিমাণে কোথায় কিছুটা কম, কোথাও বেশি। ৮ মার্চ ২০২০ সালে এদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। আমরা চেষ্টা করেছি প্রথম থেকেই করোনার লাগাম টেনে ধরতে, কিন্তু যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। তবুও ফ্রন্টলাইনার চিকিৎসকেরা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন, কঠিন এ লড়াইয়ে সামনে থেকে রোগী সেবা দিতে। প্রাণ রক্ষা করতে। সেবা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসককে জীবনও দিতে হয়েছে। করোনা প্রটেকটিভ অনেক ইকুইপমেন্টই চিকিৎসকেরা প্রথমদিকে পাননি। পেলেও তা ছিলো যথসামান্য। তবুও পিছিয়ে যাননি।
করোনা মোকাবেলা যে উদ্যোগ বা পরিকল্পনাগুলো নেওয়া হয়েছিলো সেটা পুরোপুরি সাফল্য পেলো না কেন? কোথায় আমাদের দুর্বলতা ছিলো? আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে নিতে পারিনি। প্রথম দিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিলো প্রকট। এই সমন্বয়ীহনতার কারণেও আমাদের ভুগতে হয়েছে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইন ও প্রপার আইসোলেশন করা যায়নি। যদি বিদেশ ফেরতদের কোয়ান্টোইনের বিধান কঠোরভাবে মানানো যেতো, তাহলে হয়তো আমরা অনেক ভালো অবস্থানে থাকতাম। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার কারণে নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলো ভালো আছে।
পোশাকশিল্প খাত আমাদের অন্যতম বৈদেশিক আয়ের উৎস। এদেশে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ পোশাকশিল্পে কাজ করে। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী। করোনা মহামারির কারণে হঠাৎ করেই পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা হয়। তাতে লাখ লাখ মানুষ গ্রামমুখী হয়। আবার সিদ্ধান্ত বদলে কারখানা খোলার কথা বলে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। করোনায় যেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা ও মাস্কের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিলো, সেখানে মানুষে মানুষে ঘেষাঘেষি, মাস্কবিহীন গৃহযাত্রায় করোনা বিস্তারে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো। এরকম আরও বেশকিছু সিদ্ধান্ত করোনা বিস্তারের অনুকূল অবস্থা তৈরি করে।
তবুও বিশ্বে রঅনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো করেছি। ভালো ছিলাম। ৩ শতাংশের নিচে সংক্রমণ কমিয়ে আনা গিয়েছিলো। কিন্তু আবারও করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। বলা হচ্ছে, বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীদের সঠিক পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে রাখা হয়নি। ফলে যুক্তরাজ্য কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ভ্যারিয়েন্ট এদেশে আসতে পেরেছে।
নতুন ভ্যারিয়ান্ট আমাদের উদ্বিগ্ন করলেও আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। একইসঙ্গে টিকাও নিতে হবে। টিকা নিয়ে গুজবের সুযোগ নেই। অক্সফোর্ডের টিকার এখনো বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো সমস্যার কথা যায়নি। ইউরোপেীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এই টিকা নিয়ে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে। ফলে বলা যায়, অক্সফোর্ডের এস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণে আমরা সুরক্ষিতই থাকবো। তবে সামনের সময়টাও বেশ কঠিন। বিশ্ব করোনা মহামারি থেকে মুক্ত হবে, সেই আশার পালে হাওয়া লেগেছে। দুঃসময়ে মানুষের জন্য আশা সঞ্চারির জায়গাটা টিকা। শতভাগ সাফল্য দেখাতে না পারলেও টিকাই এখন মানুষের বড় ভরসার জায়গা।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও টিকা ব্যবহারে আমরা করোনা থেকে মুক্তি পাবো, এ আশা এখন আর দূরের স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। যদিও লড়াইটা এখনো চালিয়ে যেতে হবে। কতোদিন তা জারি রাখতে হবে এখনই বলা মুশকিল। সন্দেহ নেই বিশ্ব আজ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এই সময়ের লড়াইয়ের মানুষ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। করোনা থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হতে চলে মাস্ক পরা ও হাতধোয়া অব্যাহত রাখতে হবে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। লেখক : জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ।